‘বাবা যা দিবেন হাতে হাতে দিয়েন, নাইলে আমরা কিছু পাই না’। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তির এক নারী বলছিলেন এ কথা। সাংবাদিক পরিচয় জেনে এভাবে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
এ যেন ক্ষুধার জ্বালা থেকে জন্ম নেয়া এক আস্থাহীনতার প্রকাশ।
মহামারির প্রকোপে দেশে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। চলমান দ্বিতীয় লকডাউনে নিম্ন আয়ের অনেকে কাজ হারিয়েছেন। দৈনিক আয়ে সংসার চালানো ব্যক্তিদের এখন তিন বেলা ভাত জোটাতেই কষ্ট হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে বস্তির মধ্যে মাটিতে বসে ছিলেন বিনা বেগম। পাশে ছিল ছোট দুই সন্তান। সাংবাদিক শুনে যেন কিছু একটা ফিরে পেলেন।
তিনি বলেন, ‘বাবারে ঘরে বইসা আছি। কামকাজ নাই। আমাগো কেউ খোঁজ লয় না, পোলামাইয়া লইয়া মেলা কষ্টে আছি।’
তার সঙ্গে কথা শেষ করে উঠে আসার পর পেছন থেকে ডেকে বলে উঠলেন, ‘বাবা আমাগো যা দিবেন হাতে হাতে দিয়েন, নাইলে আমরা কিছু পাই না।’
রাজধানীতে প্রজাপতি পরিবহনের বাসচালক খায়রুল আনাম। তিনি দিনভিত্তিক চুক্তিতে গাড়ি চালান। গাড়ি না চালালে বেতন হয় না তার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘লাস্ট ইনকাম করছি ১৩ তারিখ। পরিবারে আমাগো খাওনের মানুষ ৮ জন। কাম করি একাই। এই দ্যাশ পারলে আমাগো থেইকা নিবো, কিন্তু দিবো না কিছুই। গত বছরের লকডাউনে আমাগো আড়াই হাজার কইরা টাহা দেওনের কথা ছিলো, কোনো পরিবহনশ্রমিক ১০ টাহাও পায় নাই।
লকডাউনের প্রভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি বস্তির অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ছবি: নিউজবাংলা
‘কার কাছে কমু, কী জানবেন আর কীই-বা ল্যাখবেন? এই সব লেইখা লাভ নাই। কেউ কিছু দিব না। বাস্তবে আসেন আপনি। গত বছর সরকার আমাগোরে কইছিলো আড়াই হাজার টাহা কইরা দেওনের কথা। সরকার বলছে হেইডাই আমরা পাই নাই। আপনি লেইখ্যা নিয়া আর কী করবেন।’
সর্বাত্মক লকডাউনের দ্বিতীয় ধাপে এসে আর্থিকভাবে আয় না থাকার কারণে অসচ্ছল হয়ে পড়েছেন তিনি।
কষ্টের কথা বলতে গিয়ে খায়রুল আনাম বলেন, ‘আমি তিন দিন ভাত খাইবার পাই নাই, বিশ্বাস হইবো আপনের। রুটি-কলা খাইয়া আছিলাম। পরে ধার কইরা চলতাছি। আল্লায় যানে কবে গাড়ি চালামু।’
বাঁশবাড়ি বস্তিতে প্রায় আড়াই শ পরিবারের বাস। বাসা ভাড়া দুই হাজার থেকে তিন হাজারের মধ্যে। সেখানে লেগুনার হেলপার সাগরের সঙ্গে কথা হয়। তার বয়স ১৬। লকডাউনের পর থেকেই ঘরে বসে আছেন। তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল ৫ সদস্যের এই পরিবারের আহার। ঘরে রয়েছে ছোট দুই ভাই-বোন, গৃহিণী মা ও অসুস্থ বাবা।
সাগর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউনের পর থেকে লেগুনা বন্ধ। অন্য কোথাও কাজের সুযোগও পাচ্ছি না। লকডাউন আবারও বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু আমার ঘরে খাবার নাই। প্রতিদিনের আয় প্রতিদিন খাই। এখন কাজ নাই, টাকাও নাই।’
গত বছর সহায়তার অর্থ পেলেও এ বছর লকডাউনে কোনো সাহায্য পাননি রিকশাচালক আব্দুর রহিম।
গত বছর লকডাউনের সময়ে সেনাবাহিনীর সাহায্য পেলেও এ বছর কোনো সহায়তা পাননি রিকশাচালক আব্দুর রহিম। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘গত বছর সেনাবাহিনীর সাহায্য পাইছিলাম। আর কেউ সাহায্য করে নাই। এ বছর এহনো কিছু পাই নাই। কেউ কোনো সহায়তা দেয় নাই।
‘স্কুল-কলেজ বন্ধ। ভাড়া কম। রাস্তায় যাত্রী পাওন যায় না। দিনে একটু চালাইতে পারলেও রাতে চালান যায় না। পুলিশ ঝামেলা করে। রিকশা উল্টাইয়া দেয়। ১০০ থেকে ২০০ টাকা আয় করাও কষ্ট হয়ে গেছে।’
দুই নাতি, অসুস্থ ছেলে ও ছেলের বউ নিয়ে বাঁশবাড়ি বস্তিতে থাকেন হেলেনা বেগম। পেশায় গৃহকর্মী। দুইটা মেসে কাজ করতেন। কয়েক মাস আগে মেসের সদস্যরা ঢাকা ছাড়ায় তিনি বেকার হয়ে পড়েন।
হেলেনা বেগম বলেন, ‘দুইডা মেসে কাম হরতাম। হ্যারা ভার্সিটির ছাত্র আছিলো। বাড়িত গেছে সবাই। আর আমার কাম বন্ধ। আমার মতো অনেকেই আছে এই বস্তিত। হ্যাগোও কাম নাই। হ্যাগো জামাইগোও কাম নাই। সবারই এহোন না খাইয়া মরনের দশা।’
নাহার বেগম দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডের শাহজালাল হাউজিংয়ের একটি বস্তিতে থাকেন। ইট ভেঙে সংসার চালান।
হতাশা নিয়ে নাহার বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক লকডাউন তো কাটাইলাম ম্যালা কষ্টে। আবার সরকার লকডাউন দিছে। কী করমু কী খামু বুঝতেছি না। কাম না হরলে খাইতে হারি না। আমি ইট ভাইঙ্গা খাই।
‘এইহানের কেউ বাসায় কাম হরে, কেউ রিশকা চালায়, কেউ ভ্যান চালাইয়া দিন আইনা দিন খায়। আমার দুই ছেলে ছোড। কোনো কাম হরতে হারে না। ছেলেগো বাফ নাই। অনেক কষ্ট করতাছি ছেলেগোরে লইয়া।’
দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাঁশবাড়ি বস্তিতে থাকেন মো. পারভেজ। কাজ করেন কেরানীগঞ্জের আটি বাজারের একটি সেলুনে। লকডাউনে সেলুন বন্ধ, তার কাজও বন্ধ। শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছেন তিনি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সেলুনের কাম বন্ধ। রোজার টাইম চলতাছে। পরিবাররে নিয়া কষ্টের সময় কাটাইতাছি। সামনে ঈদ। খাইতেই কষ্ট হইয়া যাইতাছে আর পোলাপাইনরে ঈদে কী দিমু আল্লায় যানে। ঈদের আগে আমাগো ভালো ইনকাম হয়। যা অবস্থা দেখতাছি এবারও ঈদ ঘরে কাটাইতে হইবো মনে হইতাছে।’
মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডের শাহজালাল হাউজিংয়ের একটি বস্তিতে থাকেন রংমিস্ত্রি শাহজাহান মিয়া। কথা হয় তার সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘দ্যাশের যে অবস্থা বড়লোকেরা ঘর থেইকাই বাইর হয় না। আর বাড়ির রং করাইবো ক্যামনে? কামকাজ বন্ধ। গাড়ি-ঘোড়াও বন্ধ। জমানো ট্যাকা যা আছিলো তাও শ্যাষ। সুযোগ পাইলেই গ্যারামে যামুগা। পরিবার নিয়া ঝামেলায় পইড়া যাইতাছি।’
কথা হয় একই এলাকার ৬০ বছরের বৃদ্ধ মরজিনা খাতুনের সঙ্গে। লকডাউনে কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ কোনো সাহায্য করে না বাজান। ভিক্ষা করতে গেলে পুলিশ দাবড়ানি দেয়। ভিক্ষা কইরা খাই। সরকারের থেইকাও কিছু পাই না। কী যে কষ্টে আছি কাউরে কইতে পারি না।’
গেল এক বছরে করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এদের মধ্যে বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীই শহরে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। বিশেষ করে রিকশাচালক, নিরাপত্তাপ্রহরী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী, পরিবহন ও রেস্তোঁরাশ্রমিক, বেসরকারি স্কুলশিক্ষক ও নির্দিষ্ট বেতনে কর্মরত মানুষ।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।