গাড়িতে চিকিৎসক স্টিকার সাঁটানো, গায়ে অ্যাপ্রোন। তিনি নিজেও বলছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন।
তবে এই পরিচয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না পুলিশ কর্মকর্তা। দেখতে চাইছিলেন পরিচয়পত্র।
আর এ নিয়ে শুরু দুই পক্ষে তর্কাতর্কি। এলিফ্যান্ট রোডে গত রোববার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সাঈদা শওকত জেনির সঙ্গে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এ কাইয়ুমের তর্কাতর্কির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ওই ঘটনার জেরে চিকিৎসক ও পুলিশের প্রধান সংগঠনগুলো পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দিয়েছে। চিকিৎসকরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, তাদের হয়রানি করা হলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে। বিপরীতে পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চিকিৎসকের আচরণে পুলিশের প্রতিটি সদস্য অত্যন্ত মর্মাহত।
বিষয়টি গড়িয়েছে সর্বোচ্চ আদালতেও। চিকিৎসক-পুলিশের মধ্যে মুভমেন্ট পাস নিয়ে বাগবিতণ্ডার ঘটনায় দুই পেশাজীবী সংগঠনের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেয়া সমীচীন নয় বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।
এলিফ্যান্ট রোডে রোববারের ওই উত্তপ্ত পরিস্থিতির একপর্যায়ে ডা. জেনির একটি মন্তব্য আলাদা করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।ডা. জেনি বলছিলেন, তিনি মেডিক্যালে চান্স পেয়েছেন বলেই তিনি ডাক্তার, কিন্তু ওসি পাননি বলেই তিনি পুলিশে চাকরি করছেন।
আরও পড়ুন: লকডাউনে এবার ডাক্তার-পুলিশ বিতর্কে তোলপাড়
তবে নিউজবাংলা অনুসন্ধানে দেখেছে, মেডিক্যাল কলেজে পড়ালেখার পর বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে সুযোগ পেয়েও অনেকে পরে পেশা বদল করে পুলিশের চাকরি বেছে নিয়েছেন। এ ধরনের অন্তত ২৫ পুলিশ কর্মকর্তার খোঁজ পেয়েছে নিউজবাংলা।এছাড়া, স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে পরে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করছেন, এমন কর্মকর্তাও আছেন অনেকে।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে পরিচয়পত্র দেখানো নিয়ে পুলিশ-চিকিৎসকের তর্কাতর্কি নিয়ে নেট দুনিয়ায় ব্যাপক আলোচনা চলছে। পরে বিষয়টির মীমাংসা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ছবি: নিউজবাংলা
এই কর্মকর্তারা পেশা পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বলছেন, পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ-সুবিধা বেশি, সমাজে অবস্থানও শক্তিশালী। অন্যদিকে, চিকিৎসকদের চাকরি জীবনে অনেক ধরনের ‘প্রতিবন্ধকতার’ বিষয়টি বিবেচনা করেই তারা পেশা পরিবর্তন করেছেন।
এমবিবিএস পাস করে ২৮তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন নন্দিতা মালাকার। তবে সেই চাকরি না করে ৩০তম বিসিএসে পাস করে পুলিশে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন।
নন্দিতা মালাকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন নারী হিসেবে আমার নিরাপত্তা, পরিবারের নিরাপত্তা এবং যথাযথ সম্মান এসবের শতভাগই আমি পুলিশ ক্যাডারে এসে পেয়েছি। আমি যখন স্বাস্থ্য ক্যাডারে ছিলাম তখন এসবের কোনো কিছুই পাইনি। নারীর যথাযথ ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে পুলিশ ক্যাডার সবচেয়ে ভালো বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘আমি হেলথ ক্যাডারে থাকাকালীন উপজেলা পর্যায়ে অনেক সময় রাতে ডিউটি করতে হতো। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হতো। কাউকে দিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনলে তাকে বকশিস হিসেবে কিছু টাকা দিতে হতো, কিন্তু পুলিশে এসে দেখলাম এসব সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি নেই।
‘মেডিক্যাল অফিসার থাকাকালীন সুবিধামতো জায়গায় পোস্টিং নিতে চাইলে দেয়া হতো না। ভিআইপিদের প্রাধান্য দেয়া হতো পোস্টিংয়ের বেলায়, কিন্তু পুলিশে তেমনটা না। আমি এ পর্যন্ত সব প্রমোশন যথাযথভাবে পেয়েছি। আবার আমার স্বামী গাজীপুর চাকরি করার কারণে আমার এখানে পোস্টিং দরকার ছিল। পুলিশ হেডকোয়াটার্সে বলার পর আমাকে সেটা দেয়া হয়।’
নন্দিতা বলেন, ‘আমি মনে করি এমবিবিএস পড়েছি, সেই শিক্ষার জায়গায় ঠিক আছে। তবে পেশাগত জীবনে ডাক্তারির চেয়ে পুলিশ সার্ভিস অনেক সম্মান ও মর্যাদার।’
মেডিক্যাল থেকে পাস করে বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হয়েছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করা শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য ক্যাডারে প্রশাসনিক ক্যাডারের অনেক সুবিধাই পাওয়া যায় না।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিযোগিতা করে বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেয়ার পর একজন চিকিৎসক পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন অর্থাৎ এমডি, এমএস, এফসিপিএস ইত্যাদি ডিগ্রি না করলে তার পদোন্নতির সুযোগ থাকে না। ওই সব ডিগ্রির জন্য একজন চিকিৎসককে কয়েক বছর একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এর পর তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেন।
‘এসব শেষ করতে সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। এই পুরো সময়ে একজন চিকিৎসকের মাসিক ভাতা খুবই কম।’
চিকিৎসক সাঈদা শওকত জেনি
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি ছাড়া একজন ডাক্তারের কোনো মূল্য নেই। কারণ সবাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খোঁজেন। কিন্তু এর পেছনে যে সময় লাগে, সেই সময়ে অন্য পেশায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। এই পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়ানো, পাশাপাশি পদোন্নতি, গাড়ি-বাড়িসহ অন্য সুবিধা পেতে অনেক চিকিৎসক আজকাল মেডিক্যাল ক্যাডারের পরিবর্তে জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিতেই বেশি আগ্রহী।’
স্বাস্থ্য ক্যাডারে এসে চাকরির শুরুতে চিকিৎসকদের অন্তত দুই বছর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতে হয় জানিয়ে মেডিক্যাল উত্তীর্ণ ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়, থাকে না গাড়ির সুবিধা। অথচ প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারে গাড়ি তো বটেই, আরও অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।’
আরও পড়ুন: ডা. জেনিকে ‘পাপিয়া’ বলা ওসির শাস্তি দাবি
পুলিশ হেডকোয়াটার্সে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত আছেন শহীদুল ইসলাম। তবে তার পড়াশোনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে। চীনের উহানের খুঞ্জি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে দেশে এসে ২৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে নড়াইলের একটি উপজেলায় মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২৫তম বিসিএসে পাশ করে যোগ দেন পুলিশ ক্যাডারে।
শহীদুল ইসলামের কাছে ডাক্তারি ‘একঘেয়েমি’ পেশা। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা পেশায় একই রকম ধাচের মধ্যে থাকতে হয়, কিন্তু আমার মনে হতো পুলিশের পেশা তেমনটা নয়। এখানে ডাইভারসিটি বেশি, মেধা খাটানোর সুযোগ বেশি আর সুযোগ সুবিধার তো অভাব নাই।
‘আমার পরিবারে আরও কয়েকজন ডাক্তার আছেন। তাদের দেখেছি গতানুগতিক কাজ করেন। হাসপাতাল, রোগী আর পড়াশোনার মধ্যে মগ্ন থাকেন তারা। এর ফলে অনেক সময় আইডেন্টিটি সংকট হয়।’
পুলিশের চাকরি নিয়ে সন্তুষ্টি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে আমি এমনটা অনুভব করি না। আমি মনে করি পুলিশ ক্যাডারে আসার সিদ্ধান্তটা আমার জন্য খুব ভালো ছিলো। তাছাড়া আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তারা পুলিশ বা প্রশাসনকেন্দ্রীক চাকরিগুলোতে বেশি আগ্রহী হই। এর পেছনে নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা এমনকি সম্মান পাওয়ার ব্যাপারগুলো বেশি কাজ করে বলে আমার মনে হয়।’
এমবিবিএস পাস করে পুলিশে যোগ দেয়া মোহাম্মদ লোকমান পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ ক্যাডারে চাকরি হলে ধারাবাহিক পদোন্নতি, ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা, সরকারি বাংলো, বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনার সুযোগসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়।
‘তাছাড়া আলাদা অফিস কক্ষ, ব্যক্তিগত সহকারী এবং সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সম্মান তো আছেই।এসব কিছু বিবেচনা করেই চিকিৎসক হওয়ার চেয়ে এই ক্যাডারে আসাটা আমার কাছে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে।’
মেডিক্যালে পড়ে অন্য ক্যাডারে যাওয়ার প্রবণতা কেমন
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ক্যাডারের পরিবর্তে অন্য ক্যাডারে যাওয়ার অনেক উদাহরণ থাকলেও এর সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইশরাত শারমীন ঈশিতার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তবে তিনি বলেন, ‘কে কোন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে কোন ক্যাডারে আসলো সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের কাজ হলো সুপারিশ করা।’
বাংলাদেশ পুলিশের অফিসার্স ডিরেক্টরি ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৩৫তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে চাকরি পাওয়া ১১৪ জনের মধ্যে চার জন ছিলেন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। ৩৬তম বিসিএসে এই সংখ্যা দুই।
শুধু পুলিশ ক্যাডার নয়, এর বাইরে অন্য ১৪টি সাধারণ ক্যাডারেও মেডিক্যাল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে।
এ ব্যাপারে আক্ষেপ রয়েছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন বলেন, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। কে পোশাকের দাপটের পেছনে ছুটবে, আর কে প্রশাসনিক ক্ষমতা পাওয়ার আশায় দৌড়াবে সেটা তো আমরা নির্ধারণ করতে পারি না। বর্তমান জেনারেশন কম আলোর চেয়ে বেশি আলোর দিকে ছুটতে পছন্দ করে। তবে অনেক সময় কম আলোতে যে শান্তি বেশি, সেটা অনেকে বুঝতে পারে না। আমি শুধু বলব, পুলিশ-প্রশাসন ক্যাডারের চেয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারের মর্যাদা কম নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি মেডিক্যাল কলেজে প্রতি শিক্ষার্থীদের পেছনে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। একজন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করতে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর তিনি অন্য পেশায় চলে গেলে সেটি রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের হিসাব বলছে, দেশের সরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হিসাবে শূন্য পদের সংখ্যা অনেক বেশি।