একসময় গ্রামের রাস্তা, ক্যানেলের পাশে, কৃষিজমির আইলে অহরহ দেখা মিলত বাবলাগাছের। এর ছায়ায় জিরিয়ে নিতেন ক্লান্ত কৃষক।
এ গাছের শক্ত কাঠ দিয়ে বানানো হতো লাঙল, ঢেঁকি ও গরুর গাড়ি। এর পাতা, ফল, আঠা ও বাকল ব্যবহার করা হতো নানা ভেষজ কাজে। নাইট্রোজেন সরবরাহ করে বাবলাগাছ কৃষির উপকারই করত।
সভ্যতার বিবর্তনে গাছের এসব প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন এ গাছ কাজে লাগে কেবল ইটভাটার লাকড়ি হিসেবে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এখন আর তেমন চোখেও পড়ে না বাবলাগাছ।
কৃষকরা বলছেন, দুই যুগ আগেও একেকটি গ্রাম ঘিরে দুই থেকে তিন হাজার বাবলাগাছ ছিল। এখন খুঁজলে পাঁচ থেকে ছয়টি পাওয়া যেতে পারে।
কুষ্টিয়া সদরের সোনাইডাঙ্গা গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, বাবলার কাঠ দিয়ে ঢেঁকি, লাঙল, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, মহিষের গাড়ি এমনকি ট্রাকের বডিও তৈরি হতো। এখন এগুলোর প্রচলন নেই। আর লোহার অ্যাংগেল দিয়ে এখন স্থানীয় সব যানবাহনের বডি তৈরি হচ্ছে। তাই বাবলাগাছের চাহিদাও এখন নেই।
তিনি জানালেন, কাটাখালী মাঠে দুটি গাছ এখনও আছে। সেখানে যেতে দুই কিলোমিটার পথে আর কোনো বাবলাগাছ দেখা যায়নি।
বিত্তিপাড়া বাজারের করাতকলের কাঠ চেরাইমিস্ত্রি একরাম বিশ্বাস বলেন, সাধারণত বাবলা ভারী জিনিস তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। এটি দিয়ে আসবাব তৈরি করা যায় না। কড়া ধরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই কয়েক বছর ধরে বাবলাগাছ ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বদলে মানুষ মহানিম, মেহগনিগাছ লাগিয়েছে বেশি। এভাবেই ধীরে ধীরে বাবলাগাছ কমে গেছে।
বন বিভাগের যশোর সার্কেল এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তথ্যমতে, বাবলাগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Acacia nilotica, আর ইংরেজি নাম Gum Arabic Tree। কাঁটায় ভরা থাকে গাছটি। এর আদি নিবাস আফ্রিকায়। বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতের উষ্ণাঞ্চল, আরব ও অস্ট্রেলিয়ায় এ গাছ পাওয়া যায়।
অতীতে এ গাছের আরও কিছু ব্যবহারের কথা জানালেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান আহসান কবির রানা।
তিনি বলেন, ‘বাবলাগাছের ফল কৃষকরা আগে গরুকে খাওয়াত। এতে গাভির দুধ বৃদ্ধি পেত। বাবলার ছাল বেদনানাশক হিসেবে ও কাশি সারাতে, এর আঠা উদরাময় ও আমাশয়ের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
‘গাছে কাঁটা থাকার কারণে বাবলাগাছ বা শাখা বেড়া হিসেবে কাজে লাগত। তবে এর কাঁটা বিষাক্ত, পায়ে বিঁধলে পচন ধরত। আর কাটা সহজে মাটিতে মিশতও না।’
বন বিভাগের যশোর সার্কেলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করীম জানালেন, বাবলা মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে দেয়। মাটির নাইট্রোজেন বাড়িয়ে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। বাবলার কাঠ খুবই শক্তিশালী। রাখালের লাঠি এবং ঘর বানাতেও বাবলা কাঠ ব্যবহার হতো।
শিক্ষক আহসান ও বন কর্মকর্তা রেজাউল দুজনই জানালেন, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে এই গাছ কমে গেছে।
বাবলাগাছ বিলুপ্ত উদ্ভিদের তালিকাভুক্ত কি না, তা জানতে কথা হয় সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রাকিবুল আমিনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়াসহ এলাকাবাসীর অনাগ্রহের কারণে দক্ষিণ-পশ্চিমে এই গাছের সংখ্যা কমে গেছে। উপকূলে এখনও পর্যাপ্ত রয়েছে কিছু বাবলাগাছ। সে কারণেই নতুন যে রেড লিস্ট হচ্ছে, সেখানে থাকছে না বাবলাগাছ।’
তবে পরিবেশের কথা চিন্তা করে দক্ষিণ-পশ্চিমেও এই গাছ টিকিয়ে রাখা দরকার বলেন রাকিবুল আমিন।
সরকারি কলেজের শিক্ষক আহসান কবির রানাও বলেন, প্রকৃতি থেকে হঠাৎ দরকারি একটি উদ্ভিদের জাত বিলুপ্ত হয়ে গেলে শূন্যতা তৈরি হয়, যা পুরো ইকো-সিস্টেমের জন্যই ক্ষতিকর। তাই এটি টিকিয়ে রাখা জরুরি।
বন সংরক্ষক রেজাউল বলেন, ‘বন বিভাগ বিষয়টি আমলে নিয়েছে। আমরা সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনার বিভিন্ন এলাকায় বাবলাগাছ রোপণ করেছি। এ ছাড়া অন্য গাছের বীজ রোপণের আগে আমরা নার্স ক্রপ হিসেবে বাবলাগাছ রোপণ করছি। এতে ওই গাছের জন্য বাবলা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করছে।’
গ্রামের মানুষদের সচেতন করে বাবলাগাছ রোপণের আগ্রহ সৃষ্টিতে কাজ করবেন বলে জানান এই বন কর্মকর্তা।