কোভিড ১৯ এর জন্য দায়ী সার্স কোভ ২ প্রধানত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, এমন গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে চিকিৎসাবিষয়ক প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জনস্বাস্থ্য সংস্থা সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সম্প্রতি বলেছে, সংক্রমিত কোনো বস্তু স্পর্শের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি একেবারেই কম।
অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমিকের দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশনাস ডিজিজেস, নেচারসহ আরও কয়েকটি সাময়িকীতে দাবি করা হয়েছে, খোলা জায়গার চেয়ে আবদ্ধ পরিবেশে করোনাভাইরাস বেশি ছড়ায়। এমন অবস্থায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রচলিত কৌশল ঢেলে সাজানোর আহ্বান জোরাল হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, নতুন গবেষণার আলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গাইডলাইনে পরিবর্তন আনা দরকার।
দেশে এ ধরনের তেমন কোনো গবেষণা নেই স্বীকার করে তারা বলছেন, এ কারণেই বাংলাদেশে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তাদের সুপারিশে পরিবর্তন এলে বাংলাদেশেও সেটি কার্যকর করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই বলছে, করোনাভাইরাস মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মাধ্যমে নিকটজনের কাছে ছড়ায়। এজন্য, হাঁচি-কাশি আক্রান্তদের কাছ থেকে অন্তত ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, আক্রান্তদের চিহ্নিত করে আইসোলেশনসহ বেশকিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। এছাড়া, কোভিড ১৯ সংক্রমণের মাত্রা কমাতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউনের কৌশলও নেয়া হচ্ছে।
তবে ল্যানসেটে গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ছয় বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত হওয়ার কারণেই প্রচলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলো মানুষকে রক্ষা করতে পারছে না।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, উন্মুক্ত পরিবেশের চেয়ে আবদ্ধ জায়গায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর মাত্রা অনেক বেশি। আবদ্ধ জায়গায় বাতাস চলাচলের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে এই সংক্রমণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, কোভিডের যত সংক্রমণ, তার প্রায় ৪০ শতাংশই ঘটছে উপসর্গহীন আক্রান্তদের মাধ্যমে। এই উপসর্গবিহীন আক্রান্তদের হাঁচি-কাশি নেই, এটাও ভাইরাসের বায়ুবাহী সংক্রমণের বিষয়টিকে সমর্থন করে।
আরও পড়ুন: করোনা বায়ুবাহিত, আবদ্ধ জায়গায় সংক্রমণ বেশি: গবেষণা
এর আগে এপ্রিলের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির হালনাগাদ করা ‘সারফেস ক্লিনিং গাইডলাইন’ এ বলা হয়, সংক্রমিত কোনো বস্তু স্পর্শের মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক অনেক কম। ১০ হাজারের মধ্যে একজনেরও কম ব্যক্তি এভাবে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
করোনাভাইরাস কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতলে পড়ার পর দীর্ঘ সময় টিকে থাকে এবং সেই বস্তু স্পর্শ করলে মানুষও সংক্রমিত হতে পারে, এমন অবস্থান থেকে সরে এসে সিডিসি বলেছে, করোনার বিস্তার ঠেকাতে কেবল কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। প্রাত্যহিক জীবনে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়াই যথেষ্ট। বস্তুর উপরিতল পরিচ্ছন্ন রাখতে বিশেষ কোনো রাসায়নিক জীবাণুনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ুন: বস্তু থেকে ছড়ায় না করোনাভাইরাস, সিডিসির ইউটার্ন
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির শুরুর দিকে বিদেশি বেশকিছু গবেষণায় এসব তথ্য বিচ্ছিন্নভাবে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালাও বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। এবারও তাদের নির্দেশনায় পরিবর্তন আনা উচিত।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাতাসের মাধ্যমে করোনা ছড়ায় এটা অনেক আগেই বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটা নতুন কিছু নয়। এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়াই করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। তারা কিন্তু কথার মাধ্যমেই করোনা ছড়াচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গবেষকদের পরামর্শ বাস্তবায়নের বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভেবে দেখা উচিত। এছাড়া মহামারির বয়সও এক বছর হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন কিছু যুক্ত করে গাইডলাইন পরিবর্তন করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘শুধু বিশ্ব সংস্থা নয়, পৃথিবীর সব দেশেই গাইউলাইন পরিবর্তন করা উচিত। নতুন গবেষণার আলোকে এটা অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো গবেষণা হয়নি। সে ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনের ওপর নির্ভর করতে হবে। তবে সম্প্রতি আমাদের দেশে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গবেষণা হচ্ছে, এটা শেষ হতে কিছু দিন সময় লাগবে।’
অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমিকের দ্য জার্নাল অফ ইনফেকশনাস ডিজিজেস এ গত ফেব্রুয়ারিতে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ঘরের বাইরে বেশি সময় কাটানোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতা রয়েছে, এতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমে।
অন্যদিকে বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে গত ৩০ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দেয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকার কড়া সমালোচনা করা হয়। ওই নিবন্ধেও দাবি করা হয়, উন্মুক্ত পরিবেশের চেয়ে বদ্ধ জায়গাতেই করোনাভাইরাস বেশি ছড়ায়।
এসব গবেষণা তথ্যের সঙ্গে লকডাউনের কৌশল সাংঘর্ষিক কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘গবেষণায় করোনা শুধু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় এটা বলা হয়নি। যারা অসুস্থ তাদের সংস্পর্শেও ছড়াচ্ছে। লডউাউনের মাধ্যমে করোনা ছড়ানোর উৎসগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন যদি মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে তাহলে আগামী ১০ দিনের মধ্যে ভালো কিছু পরিবর্তন হবে।’
দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন এসব গবেষণায় যা বলা হচ্ছে তার যুক্তি রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা হয়নি।’
বাংলাদেশের মতো দেশে লকডাউনের প্রয়োজন ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘যে জন্য আমাদের দেশে লকডাউনে দেয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। লকডাউনের মাঠে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো লোককে দেখা যাচ্ছে না। যেসব এলাকায় বেশি সংক্রমণ হয়েছে সেখানে গণহারে পরীক্ষা করে রোগী শনাক্ত করা উচিত ছিল, সেটা করা হয়নি। এ সময়ে যদি করোনা রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশনে নেয়া যেত তাহলে হয়ত আমরা লকডাউনের সুবিধা পেতাম।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা ইউনিটের ত্রুটি স্বীকার করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে বাতাস বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসকেরা পিপিই পরে দায়িত্বপালন করছেন। যেহেতু করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় তাই এসব ইউনিটের ওপর দিয়ে বাতাস বের করার একটি ব্যবস্থা করতে হবে।’
করোনাভাইরাসের চরিত্র নিয়ে দেশে গবেষণা বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন গবেষণার আলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা পরিবর্তন জরুরি। একইসঙ্গে আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা করতে হবে। আইসিডিডিআর,বি অথবা আইইডিসিআর এটা করতে পারে, তবে তাদের জনবল খুবই কম। এজন্য সরকারের অর্থ বরাদ্দ দেয়া উচিত।’
অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষক ডা. সমীর কুমার সাহা ও তার মেয়ে ডা. সেঁজুতি সাহা বাংলাদেশে প্রথম করোনার জিন মানচিত্র তৈরি করেন। ডা. সমীর কুমার সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হচ্ছে। এটি নতুন একটি মহামারি বলে নতুন নতুন গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য আসছে। এটা স্বভাবিক। আমাদের উচিত হবে আমাদের দেশে এ ধরনের গবেষণা করা। সেক্ষেত্রে বিশ্ব সংস্থা সংস্থার নীতিমালা বা গাইডলাইনে এখনই পরিবর্তনের আগে আরও বিস্তর আলোচনা করা উচিত।’
করোনাভাইরাস নিয়ে বিস্তর গবেষণা না হলেও এই ভাইরাসে কাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি, সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কাদের বেশি সতর্ক থাকা উচিত, এসব বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনায় মৃত্যুঝুঁকি কমাতে গবেষণায় যে সুপারিশ আসবে, সে অনুয়ায়ী কাজ করা হবে। গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে আগামীকাল (রোববার) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও দেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা হবে।’