হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি। দুর্মুজ দিয়ে মাটি শক্ত করা হয়নি। বাঁধের ঢালে লাগানো হয়নি দূর্বাঘাস। এভাবে কাজ অপূর্ণ রেখে ইতি টানা হচ্ছে বাঁধরক্ষা প্রকল্পের।
হাওরের বাঁধের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে হাওরবাসী। বাঁধের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই কাজ পরবর্তী চূড়ান্ত প্রতিবেদন (পোস্ট ওয়ার্ক) তৈরির শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
হাওরের কৃষক নেতারা অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতি জায়েজ করতে লোকদেখানো কাজ বাস্তবায়ন করছে একই চক্র।
সরকার এ বছর ১১৯ কিলোমিটার বাঁধ রক্ষায় ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
বাঁধ নির্মাণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বাঁধ নির্মাণে জড়িত স্থানীয় প্রশাসন প্রকল্প গ্রহণে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় ওই সময়ে কাজ শুরু হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল গণশুনানির মাধ্যমে প্রকৃত কৃষকদের বাঁধের কাজে যুক্ত করতে হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা তা না করে পছন্দের লোকদের ডেকে এনে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে। এ কমিটি বিভিন্ন ধাপে ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ৮১১টি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের অর্ধেক কাজকেই অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন কৃষক ও হাওর আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ।
তাদের দাবি, হাওরের ফসলক্ষা বাঁধে বিপুল বরাদ্দের সুযোগে প্রকল্পে অপ্রয়োজনীয় অংশ যুক্ত করার মাধ্যমে অর্থ লোপাট হচ্ছে। এমন অভিযোগ করে হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম (হ্যাপ) নামের একটি সংগঠন গত ২৫ মার্চ সুনামগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে অভিযোগ করা হয়, বাস্তবায়ন কমিটিতে ‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা’ যুক্ত হওয়ায় কাজে বিলম্বের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে।
এই চক্রই এবার পোস্ট ওয়ার্কের কাজ করছে বলে তাদের অভিযোগ। এ ছাড়াও ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ও ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে মানববন্ধনসহ নানা প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করছে চলছে প্রতিনিয়ত।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার উদগল হাওর ঘুরে দেখা যায়, এখানে অপ্রয়োজনীয় তিনটি প্রকল্পে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে পাউবো। ওই বাঁধগুলোর বেশির ভাগ অংশই এখনও দুর্মুজকরণ হয়নি। বাঁধের বেশির ভাগ স্থানে দূর্বাঘাস লাগানো হয়নি।
ওই হাওরের ৪৮ নং প্রকল্পে সামান্য কাজ করে বরাদ্দ লোপাটের চেষ্টা চলছে বলে কৃষকেরা অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া তাহিরপুর উপজেলার ঝালোখালি-নান্টুখালি বাঁধের রাধানগর এলাকায়ও নিম্নমানের কাজ হয়েছে বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য মনেছা বেগম। ওই বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তা ছাড়া দুর্গম এলাকার বাঁধগুলোতে নিম্নমানের কাজ হওয়ায় বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের ধাক্কায় এসব বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানান, ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তী সময়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ৭ মার্চের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই নির্দেশনা মেনেও কাজ শেষ করা হয়নি। এখন কাজ শেষ হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করেছে পাউবো। পাউবোর ২২টি দল গত ২ এপ্রিল থেকে অভিযুক্ত উপসহকারী প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ারদের নিয়ে ‘পোস্ট ওয়ার্ক’ করছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্মে (হ্যাপ) সমন্বয়ক শরিফুজ্জামান শরিফ বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহে একাধিক হাওর ঘুরে দেখেছি, এখনও বাঁধের দুর্মুজকরণ ও দূর্বাঘাস লাগানো হয়নি। তা ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনা ও দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ লোপাট হচ্ছে। সরকারের বিপুল বরাদ্দের সুযোগ নিয়ে একটি দুর্নীতিবাজ চক্র এই অনিয়মের জড়িত।’
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘আমরা আন্দোলন করে পিআইসি-প্রথা এনেছিলাম। এই প্রথাকে সমালোচিত করতে একটি চক্র নীতিমালা না মেনেই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প দিয়ে সরকারের টাকা লুটে নিচ্ছে। এবারও পাল্লা দিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতিকেই ধ্বংস করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২ মো. শামসুদ্দোহা দাবি করেন, বাঁধের কাজে ও প্রকল্প গ্রহণে অনিয়ম হয়নি। তিনি বলেন, ‘বাঁধের কাজ শেষ। এখন হাওরে পোস্ট ওয়ার্ক করছে ২২টি টিম। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে তা কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজ শেষ হলেই বোঝা যাবে, কাজ কতটুকু হয়েছে।