দেশে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) দায়ী বলে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য প্রকাশের পর তৈরি হয়েছে টিকা নিয়ে নতুন উৎকণ্ঠা।
যেখানে এই ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তি সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় সম্প্রতি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের ভাইরাসের বিরুদ্ধে খুব বেশি কার্যকর নয় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। আর বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে এই টিকাই প্রধান ভরসা কোটি কোটি মানুষের। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, টিকার নতুন উৎস না পাওয়া পর্যন্ত বর্তমান টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
আইসিডিডিআর,বি বুধবার যে গবেষণার তথ্য প্রকাশ করে তাতে দেখা গেছে, গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে গবেষকেরা ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ৪৬টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনের উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সার্বিকভাবে ৮১ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার এই ধরনটি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক।
এর আগে ১২ থেকে ১৭ মার্চ গবেষকেরা ৯৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬৪টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন পাওয়ার কথা জানান, যা সার্বিকভাবে ছিল ৬৪ শতাংশ। আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্ট বা অন্যগুলোর পরিবর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টটি সর্বাধিক প্রচলিত রূপে পরিণত হয়েছিল।’
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা অনেক কম। চিকিৎসাবিজ্ঞান সাময়িকী নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বি.ওয়ান.থ্রি-ফাইভ-ওয়ান ভাইরাসটির (দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট) মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দুই ডোজের কার্যকারিতা মাত্র ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সের গড় হিসেবে এইচআইভি নেগেটিভ ত্রিশোর্ধ্বদের ওপর পরীক্ষাটি চালানো হয়েছে। ২০২০ সালের ২৪ জুন থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক এ পরীক্ষায় অংশ নেন। এদের মধ্যে আড়াই শতাংশ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেয়ার ১৪ দিনের বেশি সময় পর কোভিড নাইনটিনে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গ দেখা গিয়েছিল।
আর টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট ৪২ জন। এদের মধ্যে ৩৯ জন, অর্থাৎ ৯৩ শতাংশের দেহে শনাক্ত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি।
এই গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দুর্বল কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। করোনা ঠেকাতে সারা বিশ্বে লডডাউনের কৌশল নেয়া হয়েছিল ব্রিটেনের অধ্যাপক নিল ফার্গুসনের পরামর্শে। তিনিও গত সোমবার বিষয়টি নিয়ে শংকা জানিয়েছেন।
দেশের বিশেষজ্ঞরাও উদ্বিগ্ন
করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ‘দুর্বল শক্তি’র তথ্যে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদেরও উদ্বেগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বিকল্প উৎস থেকে টিকা আনার ব্যাপারে মত দিয়েছেন অনেকে। তবে টিকার নতুন উৎস নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকাদান অব্যাহত রাখতে চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. নজরুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের উচিত হবে টিকার বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে ধরা পড়ছে। আইসিডিডিআর,বির গবেষণাতে এমন তথ্যই এসেছে। নতুন বৈশিষ্ট্যের এই করোনা মোকাবিলায় অকার্যকর প্রমাণিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। ফলে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় নয়, আরও কয়েকটি দেশও টিকার প্রয়োগ স্থগিত করেছে।’
এমন পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সরকার অবশ্যই আলোচনা করবে। এরপর হয়ত একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে অভিযোগ তুলছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ও বিশেষজ্ঞদের বসে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।’
এ বিষয়ে আইসিডিডিআর,বির একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার পর হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে নতুন স্ট্রেইন দায়ী। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট নয়, অনেক দেশের ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে শনাক্ত হচ্ছে। এ ধরনের ভ্যারিয়েন্ট আসতেই থাকবে। যে কারণে প্রতিবছরই ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট অনুযায়ী টিকা পরিবর্তন করা হয়। আল্টিমেটলি হয়ত করোনা ভ্যাকসিনও সেই অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হবে। ’
করোনা থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দেন তিনি। ওই গবেষক বলেন, ‘যে ভ্যারিয়েন্ট দেখা যাচ্ছে তাতে তরুণেরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। কারণ তারা ঘরের বাইরে বেশি থাকেন, স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে উদাসীন। ফলে তারাই শুধু আক্রান্ত হচ্ছে না, পরিবারকেও ঝুঁকিতে ফেলছেন।’
দেশে অ্যাস্টাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা নিয়ে আইসিডিডিআর,বি কোনো গবেষণা করেনি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এতটুকু বলতে পারি বিশ্বের যে কোনো টিকাই করোনা প্রতিরোধে একশ ভাগ সুরক্ষা দিচ্ছে না। ফাইজার বলেন, মর্ডান বলেন বা অন্য যে কোনো টিকাই বলেন, কোনোটিই শতভাগ সুরক্ষা দেয় না। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা নিউজবাংলাকে বলেন, এখন যে টিকা আছে সেটাই চলমান থাকবে। তবে অন্য উৎস থেকে টিকা নিশ্চিতে যোগাযোগ চলছে।’
নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘ভাইরাস বা টিকার বিষয়গুলো এখনও গবেষণাধীন। আর কোনো টিকাই শতভাগ কার্যকারিতার নিশ্চয়তা দেয় না। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও তেমন। আমাদের হাতে এখন যে টিকা আছে, আমরা সেটা নিয়েই করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করব।’
করোনাভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর নাসিমা সুলতানাও জোর দেন।