জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বিষাক্ত মিথেন গ্যাস উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।
প্যারিসভিত্তিক কেয়রোজ এসওএস নামের প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি।
গ্রিনহাউজ গ্যাসের মধ্যে অন্যতম ক্ষতিকর হলো মিথেন। দীর্ঘস্থায়ীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী এ গ্যাসটি। তালিকার বাকি নামগুলো হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ও ওজোন।
পরিবেশবিদদের মতে, গত ২০ বছরে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে পরিবেশের ৮০ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে মিথেন।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর মিথেন নিঃসরণকারী শীর্ষ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে কেয়রোজ এসওএস। এতে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চীন-যুক্তরাষ্ট্রসহ তালিকার শীর্ষে থাকা বেশিরভাগ দেশই ধনী রাষ্ট্র।
উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়েও মিথেন নিঃসরণকারীদের তালিকায় শীর্ষে বাংলাদেশ।
ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইএসএ) সেন্টিনেল-ফাইভপি ও সেন্টিনেল-টু স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে কেয়রোজ জানিয়েছে, বাংলাদেশে মিথেন নিঃসরণে সবচেয়ে বেশি দায়ী ধানক্ষেত, ময়লার ভাগাড়, প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইনে ফাটল, কয়লা পোড়ানোসহ নানা কারণ।
ইএসএর তথ্য বিশ্লেষণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসও। গত মে মাসে ফ্লোরিডার আকাশে মিথেন গ্যাস মিশ্রিত ধোঁয়ার বিশাল একটি আস্তর শনাক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্বের ১৩০টির বেশি দেশে কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠানটি মিথেন মিশ্রিত একই রকম একটি আস্তর শনাক্ত করেছে বাংলাদেশেও।
ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ইয়োতাম এরিয়েল বলেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণে বিশ্বে মিথেন নিঃসরণের জন্য দায়ী অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। স্যাটেলাইটের পাঠানো তথ্যে এটি স্পষ্ট।’
বিজ্ঞানীরা মিথেনের সবচেয়ে বড় উৎসগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছেন খুব বেশি দিন হয়নি। মেঘের আস্তর, বৃষ্টিপাত, আলোর পার্থক্যসহ নানা কারণে সারা বছর মহাকাশ থেকে সব অঞ্চলের মিথেন নিঃসরণ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলে ব্যাপক তেল ও গ্যাস উত্তোলন সত্ত্বেও অঞ্চলটির উচ্চতার কারণে স্যাটেলাইট থেকে মিথেন নিঃসরণের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন।
কিন্তু মিথেন নিঃসরণে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিশেষ করে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ হওয়ার পরও উচ্চ মাত্রার মিথেন নিঃসরণের কারণেই এ উদ্বেগ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। জোটের ৪৮টি সদস্য দেশের ১২০ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনগত ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছে ব্লুমবার্গ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের এসব সমস্যা আমরা জানি। সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।’
গ্লোবাল মিথেন ইনিশিয়েটিভের তথ্য অনুযায়ী, গবাদি পশু, তেল ও গ্যাস শিল্পভিত্তিক কারখানার পাইপলাইনে ফাটল, কয়লা ও ময়লা পোড়ানো মিথেন নিঃসরণের মানবসৃষ্ট উৎস।
এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ড (ইডিএফ) বলছে, বর্তমানে সারা বিশ্বে যত মিথেন নিঃসরন হচ্ছে, তার কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠেকাতে যারা কাজ করছেন, তাদের উদ্বেগের অন্যতম কারণ মিথেন। গ্যাসটি গন্ধ ও বর্ণহীন বলে এটি ছড়ালেও শনাক্ত করা কঠিন।
ইডিএফের প্রধান গবেষক স্টিভেন হ্যামবার্গ বলেন, ‘বাংলাদেশের ওপর মিথেনের যে আস্তর রয়েছে, তা এক ধরনের সতর্কবার্তা। এটি নিয়ে অনেক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। নিঃসরণের সঠিক মাত্রা নির্ণয় ও উৎস শনাক্ত করা ছাড়া এ সংকট সমাধানের কোনো উপায় নেই।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ লকডাউন সত্ত্বেও সারা বিশ্বে বায়ু দূষণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ।