স্কুলে পিটুনি আইন করে বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে অনেকটাই। তবে কওমি মাদ্রাসায় এখনও এই সমস্যা ব্যাপক।
পড়া না পারলে তো কথাই নেই, শিশুরা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে, এক শিক্ষকের ঘরের হিটার আরেক শিক্ষকের কক্ষে রাখলে, দেখতে আসা মায়ের দিকে ছুটে গেলে শিশুদের বেদম পিটুনির কথা গত ১০ দিনে গণমাধ্যমে এসেছে।
বেশ কিছু ঘটনার ভিডিও নানা সময় এসেছে গণমাধ্যমে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে আশুলিয়ার একটি মাদ্রাসায় দুটি শিশুকে আছড়ে ফেলে উপর্যুপরি বেত্রাঘাতের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
এর মধ্যে না বলে বাড়ি যাওয়ার কারণে বাগেরহাটের একটি মাদ্রাসায় শিশুকে ফ্যানে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। ভালুকার একটি মাদ্রাসায় পিটুনিতে একটি ছেলে মারাই গেছে।
এ নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে ব্যাপক। বাবা-মা বা স্বজন প্রায়ই মামলা করছেন। শিক্ষকরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক কওমি আলেমের ছয় মাসের কারাদণ্ডও হয়েছে।
কিন্তু কওমি আলেম তথা মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের যেন কোনো ভাবান্তরই নেই।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সাভারের আশুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় ছাত্রকে পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হলে অনেক সমালোচনা শুরু হয়। ফাইল ছবি
পুরোপুরি ‘নির্বিকার’ কওমি মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের- বেফাক।
এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি নেই সংগঠনের, কোনো নির্দেশনা নেই। যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলানো কঠিন।
বিষয়টি নিয়ে বেফাক মহাসচিব মাহফুজুল হকের সঙ্গে কথা বলতে টানা দুই দিন চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। তার মোবাইল ফোনে কল করা হয়েছে অসংখ্যবার। তিনি ফোন না ধরার পর দেয়া হয়েছে এসএমএস।
এতেও সাড়া না দেয়ায় শনিবার যাত্রাবাড়ীর কাজলায় শিক্ষা বোর্ডের কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
রোববারও ফোন ধরেননি তিনি। সেদিনও এসএসএমে সাড়া পাওয়া যায়নি।
বেফাক কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায় মহাপরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ যুবায়েরকে। তিনি কিছু বলতে নারাজ। বললেন, কথা বলবেন মহাসচিব।
পরে এ নিয়ে পীড়াপীড়ির পর তিনি বলেন, ‘আমরা মাদ্রাসাগুলোতে যোগাযোগ রেখেছি। মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে, কথাবার্তা বলছি, যাতে ছাত্র নির্যাতন না করা হয়। আমরা তাদের নির্যাতন না করতে বলি। তবে এ বিষয়ে আমরা পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিইনি।’
তিনি বলেন, ‘মুরব্বি হিসেবে আমাদের যতটুকু বলার আমরা বলছি। সে সম্পর্কে আমরা কোনো মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করিনি।’
যাদের বিষয়ে ছাত্র নির্যাতনের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো কারও ওপরে আইন প্রয়োগ করার অধিকারী না।’
সারা দেশে মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপর শিক্ষকদের চড়াও হওয়া, যেসব নির্যাতন, তা কমছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের শব্দ আপনারা কেন ব্যবহার করেন? আমরা কি চড়াও হওয়ার পক্ষে?’
বাগেরহাটে ছাত্রকে ফ্যানে ঝুলিয়ে নির্যাতন করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন মাদ্রাসাশিক্ষক। ফাইল ছবি
২৪ ঘণ্টা মাদ্রাসায় না রাখা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পক্ষে এক আলেম
কওমি আলেমদের মধ্যেই সংস্কারের দাবি আছে। কওমি মাদ্রাসার হাফেজখানায় ২৪ ঘণ্টা শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে ছাত্ররা– এই পদ্ধতির পরিবর্তন চান রাজধানীর জামিয়া ইকরা বাংলাদেশের অধ্যক্ষ ও কাকরাইলের সার্কিট হাউস জামে মসজিদের খতিব মাওলানা আরিফ উদ্দিন মারুফ।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক শিশু অনেক সময় দুষ্টুমি করে। আমাদের বাসায় দুই-তিন সন্তানের দুষ্টুমিতেই আমরা অনেক সময় অতিষ্ঠ হয়ে যাই। সেখানে যখন ২০ থেকে ৩০টি শিশু ২৪ ঘণ্টা একজন শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তখন তো অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকের মেজাজ ঠিক থাকে না। তাই বলে যেভাবে শিশুদের প্রহার করা হয়, তা সমীচীন নয়।
‘জেলখানার মতো ছাত্রদের সেখানে আবদ্ধ করে রাখা, বিনোদনের ব্যবস্থা না করা, এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমরা যারা কর্তৃপক্ষ রয়েছি, শিক্ষকদের এই সময়টার বিষয়ে চিন্তা করা উচিত।’
শিশুদের যেভাবে শাসন করা হয়, সেটা ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলাম এটা সমর্থন করে না বলেও মন্তব্য করেন এই কওমি আলেম।
চট্টগ্রামের আরেকটি মাদ্রাসায় চার ছাত্রকে পেটানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় শিক্ষককে। ফাইল ছবি
এর সমাধান কী, জানতে চাইলে মাওলানা মারুফ বলেন, ‘আমাদের এখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দরকার। যে জিনিসটা কওমি মাদ্রাসাগুলোতে আছে, কিন্তু যেভাবে থাকা দরকার সেভাবে নেই।
‘আর একটি বিষয় হলো, অনেক মানুষ আছে যারা সহজে রেগে যান। তবে শিক্ষকদের এই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রাগের যেন সীমা লঙ্ঘন না হয়। আর শিক্ষকদের মানসিক প্রশিক্ষণও দরকার।’
প্রশিক্ষণের ঘাটতিই কি কারণ?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদ্রাসাশিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। এ কারণে তারা শিশুদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সেটা জানে না। আর মাদ্রাসায় যেসব অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠায় তারাও সচেতন না। এ কারণে নির্যাতন হলেও তারা তেমন কিছু বলে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে ছাত্র নির্যাতনের একটি পরিবেশ অনেক দিন থেকেই চলে আসছে।’
এভাবে পেটানোর পেছনে শিক্ষকদের মানসিকতাই দায়ী বলেও মনে করেন মনোবিজ্ঞানের এই শিক্ষক। বলেন, ‘আমার মনে হয় ছাত্র নির্যাতনে তারা একধরনের আনন্দ অনুভব করেন। এটা অবশ্যই একটা মানসিক বিষয়।’
এ সমাধান কী জানতে চাইলে এই অধ্যাপক বলেন, ‘সমাধান হলো যারা সেখানে ছেলে-মেয়ে দেবে তারা যেন সচেতন হয়। অভিভাবক বলবে কোনোভাবেই যেন এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন না চালানো হয়। সেই সঙ্গে নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন।’
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
সম্প্রতি চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মারকাযুল কোরআন ইসলামিক একাডেমি নামে একটি হাফেজি মাদ্রাসাতেও একটি শিশুকে পেটানোর ভিডিও প্রকাশ হয়। শিশুটির মা তাকে দেখতে এসেছিল। মা ফিরে যাওয়ার সময় ছেলেটি তার পিছু নেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া শিশুটিকে ঘাড় ধরে টেনে কক্ষে নিয়ে ব্যাপক মারধর করেন। আর সেই ভিডিও ভাইরাল হয় ফেসবুকে।
সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতে দুদিন পর একই জেলার সাতকানিয়া উপজেলার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের গারাংগিয়া রংগিপাড়া হেফজখানা ও এতিমখানায় চার শিশুকে মারধরের ঘটনা ঘটে। নির্যাতিত ছাত্রদের পিঠে বেত্রাঘাতের ছবি আসে গণমাধ্যমে।
১৪ মার্চ রংপুরের গংগাচড়ায় একটি মাদ্রাসায় দুই ছাত্রকে নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় দুই ছাত্র মাদ্রাসায় আর পড়বে না বলে জানিয়েছে গণমাধ্যমকে।
১০ মার্চ ময়মনসিংহে ছাত্র পেটানোর অভিযোগে মাদ্রাসার এক শিক্ষককে সাত দিনের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক শিক্ষকের কারাদণ্ড হয় ছয় মাস।
এর মধ্যে ২২ মার্চ বাগেরহাটের রামপালে একটি মাদ্রাসায় এক ছাত্রকে ফ্যানে ঝুলিয়ে পেটানো হয়। পরে পরিবারের অভিযোগের পর গ্রেপ্তার করা হয় সন্দেহভাজন শিক্ষককে।
এ মাসের শুরুতে ফেনীতে মাদ্রাসাছাত্রকে পিটিয়ে জখম করেন এক শিক্ষক। ফাইল ছবি
পিটুনি সংবিধানবিরোধী, দণ্ডণীয়
২০১১ সালে হাইকোর্ট শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়ার বিষয়টি বেআইনি এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করে৷ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্রও জারি করে।
এতে বলা হয়, হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা উঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করিয়ে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ৷
এই পরিপত্রে শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ শিশুদের শারীরিক শাস্তি দিলে ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷
রংপুরের গংগাচড়ায় এক মাদ্রাসাশিক্ষক পিটিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে আহত করলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফাইল ছবি
অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷ প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে৷
তবে কওমি মাদ্রাসাগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় কখনও নিয়ন্ত্রণ করে না। আর এ কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। আবার বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, অভিভাবকরা আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা করেন না পরকালের কথা ভেবে।
হাটহাজারীতে সন্তানকে পিটুনির পর স্থানীয় প্রশাসন শিক্ষককে আটক করে নিয়ে এলেও নির্যাতিত শিশুর বাবা-মা-ই তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। পরে সমালোচনার মধ্যে পুলিশ মামলা করে ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে।
বছর দুয়েক আগে চুয়াডাঙ্গায় একটি মাদ্রাসায় এক ছাত্রকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়ার পর শিশুটির বাবা মামলা করেও তা তুলে নেন। কারণ, স্থানীয় লোকজন তাকে বোঝান আলেমের বিরুদ্ধে মামলা চালালে আখেরাতের জন্য ভালো হবে না।