র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের সেই লিমন হোসেন এখন একজন শিক্ষানবিস আইনজীবী ও শিক্ষক। সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক তিনি। হাসিখুশি এই মানুষটি ক্যাম্পাসে বেশ প্রিয়। দেখে বোঝার উপায় নেই, কোনো এক সময় এই মানুষটির জীবনে নেমে এসেছিল দুর্বিষহ যন্ত্রণা।
১০ বছর আগে লিমনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে পায়ে গুলি করেছিলেন র্যাব সদস্যরা। পা হারিয়ে সেই থেকে শুরু হয় লিমনের জীবনযুদ্ধ।
২০১১ সালে লিমনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও অস্ত্র আইনে করা হয় দুটি মামলা। তবে ২০১৩ সালে মামলা দুটি থেকে লিমনকে বাদ দেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০১১ সালেই লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম ঝালকাঠি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করেছিলেন। কিন্তু ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও মামলার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
২০১৩ সালে লিমনকে সাভারের আশুলিয়ায় গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে স্নাতক সম্মান কোর্সে ভর্তি করান ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ২০১৭ সালে অনার্স শেষ করে কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন লিমন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সহকারী প্রভাষক হিসেবে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি।
নিউজবাংলার একান্ত সাক্ষাৎকারে লিমন হোসেন বলেন, ‘আমার মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। যে মামলাটি আমাকে হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্যে গুলি করার। মামলাটি বর্তমানে বরিশাল পিবিআই-এর কাছে তদন্তাধীন। আমি চাই একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রতিবেদনটা প্রকাশ করা হোক। একটা সময় আমরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছিলাম। সেটা তো আমরা পাইনি। র্যাব থেকে পিবিআইয়ের কাছে তদন্ত চাওয়া হয়েছিল। সেই মোতাবেক পিবিআইয়ের কাছেই মামলার তদন্তভার আছে। আসলে বাংলাদেশে একটি মামলা তদন্ত করতে কত দিন লাগে? এটা আমার জানা নাই। আমি চাই, এটা যেন আলোর মুখ দেখে। সরকারের কাছে এটা আমার আকুল আবেদন।’
২০১১ সালে র্যাব যখন লিমনের পায়ে গুলি করে, তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। লিমন বলেন, ‘একটা বাহিনীর সাথে ফাইট করার জন্য দেশের মানুষ ও সাংবাদিকদের একটা ভূমিকা ছিল। সবচেয়ে বড় সাহস ছিল আমার মা এবং আমার সৎ সাহস, যে আমি কখনও সন্ত্রাসী ছিলাম না, আমাকে সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে পারবে না। এখন পিবিআই যে তদন্ত করছে ওখানে নিশ্চয় আমি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি, আর র্যাব দোষী বলেই তদন্ত আলোর মুখ দেখছে না।’
ঝালকাঠি জেলা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আক্কাস শিকদার বলেন, ‘পুলিশ প্রতিবেদনে লিমনকে র্যাব গুলি করেনি উল্লেখ করা হয়েছিল। ফলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লিমনের মা জেলা জজ আদালতে রিভিশন পিটিশন করেন। পাঁচ বিচারক এই রিভিশনটা শোনেন নাই। একের পর এক টাইম পিটিশন মঞ্জুর করেছেন। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল ৪২তম তারিখে একজন অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জজ এটা মঞ্জুর করেন। একই সালের ২২ এপ্রিল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে পুনরায় একজন বিসিএস কর্মকর্তাকে এই মামলার তদন্ত করার নির্দেশ দেন। বর্তমানে পিবিআইতে মামলাটি আটকে আছে।’
এই আইনজীবী আরও জানান, ‘আমাদের ধারণা, এই মামলার যে সমস্ত ডকুমেন্ট আছে, তাতে চার্জশিট হওয়ার কথা। তবে র্যাবের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশে কোনো এজেন্সির আছে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ র্যাবও পুলিশ, আর পিবিআইও পুলিশ। এখন সেখানে তারা কতটা তদন্ত করবে বা এই তদন্ত কর্মকর্তারা কোনো ঝুঁকি নেবেন কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।’
লিমন বলেন, ‘র্যাব আমাকে গুলি করায় ওই সময় আমার পা কেটে ফেলতে হয়। গুলি, হামলা, মামলা করেই এরা ক্ষান্ত হয়নি। একটা সময় এরা আমার পরিবার ও আত্মীয়দের উপরেও প্রচণ্ড চাপ দিত। এমনকি এখনও র্যাবের কথিত সোর্স ইব্রাহিম আমার ভিটেমাটি দখল করে আছে।’
২০১১ সালের ২৩ মার্চ র্যাবের গুলিতে পা হারান লিমন
লিমন বলেন, ‘মানসিকভাবে আমি খুব একটা ভালো নেই। কারণ আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাড়িতে থাকি না। র্যাবের কথিত সোর্স ইব্রাহিম হাওলাদার এখন ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ নেতা বনে গেছেন। তিনি ও তার লোকজন আমাদের পৈতৃক ভিটায় ঘর তুলতে দিচ্ছেন না। চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ইব্রাহিমকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। আমাদের স্থায়ী একটা থাকার জায়গা নাই। আমারা বাবা-মা এখন পার্শ্ববর্তী কাউখালী থানার একটি ভাড়া বাসায় থাকছেন।’
রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হেমায়েত হোসেন নুরু মিয়া বলেন, ‘যে সময় র্যাব লিমনকে গুলি করে, তখন ইব্রাহিম ও বর্তমান চেয়ারম্যান লিমনের বিপক্ষে কাজ করেছে। ইব্রাহিম তো ভালো লোক না। সে র্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করত। বর্তমান চেয়ারম্যানের সাপোর্টেই সে এলাকায় নানা অপকর্ম করে আসছে। ছিদ্দিক চেয়ারম্যানও ডাকাতির মামলায় সাত বছর জেলে খেটেছেন।’
এ ব্যাপারে সাতুরিয়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা লিমন হোসেন তার স্বপ্ন নিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আইনি সহায়তা দিতে চাই। আমার একটা সময় ইচ্ছা ছিল, আমি মানবাধিকার আইনজীবী হব। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করাটাই আমার ইচ্ছা। আমার পাওয়ার কিছু নাই। আমি জীবনে সব পেয়েছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমি নতুন করে একটা জীবন পেয়েছি। এ জন্যই সারা দেশের মানুষ ও সুশীল সমাজের মাধ্যমে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে চাই।
‘আমি যা হারিয়েছি তা কোনোদিনও পূরণ হবার নয়। তবে দেশের ইলেকট্রানিক, প্রিন্ট মিডিয়া, বিভিন্ন সংগঠন, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ আমার পাশে ছিল। তাদের সহানুভূতি, ভালোবাসা ও দোয়ায় আমি সুস্থ্ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারছি। বিশেষ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ স্যারের কারণে আজ আমি এখানে। আর সিডিডির দেয়া পায়ে আমি হাঁটতে পারছি। এরা আমার পাশে যেভাবে দাঁড়িয়েছে, এভাবে সহযোগিতা না করলে আজকে হয়তো আমি লিমন হিসেবে বাঁচতে পারতাম না। বাঁচলেও হয়তো সন্ত্রাসীর তকমা লাগিয়ে বাঁচতে হতো।’
লিমনের মায়ের করা মামলার এজহারে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে মায়ের সঙ্গে গরু আনতে গিয়েছিলেন ঝালকাঠি জেলার লিমন হোসেন। এ সময় তিনটা মোটরসাইকেলযোগে ছয়জন র্যাব সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। পরে লুৎফর রহমান নামে এক র্যাব সদস্য লিমনের শার্টের কলার ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন। তখন লিমন তার পা ধরে কেঁদে বলেন, ‘আমি সন্ত্রাসী না, আমি স্টুডেন্ট। পাশের ইটভাটায় আমি কাজ করি। খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাই।’
তখন লুৎফর রহমান লিমনের মাথায় গুলি না করে পায়ে গুলি করেন।