বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শাল্লার হামলায় ঠাকুরপাড়ার ছায়া

  •    
  • ২০ মার্চ, ২০২১ ১৯:১৩

ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে গংগাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ও বালাবাড়ি গ্রাম এবং রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর গ্রামের ৮ থেকে ১০ হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বাধা দিলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও লাঠি ছুড়তে থাকে। একদল গিয়ে ঠাকুরপাড়া গ্রামে কয়েকটি হিন্দুবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে ভস্মীভূত হয় ১১টি বাড়ি। ভাঙচুর করা হয় মন্দিরও। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হাবিবুর রহমান হাবিব নামে এক যুবক নিহত হন।

রংপুরের ঠাকুরপাড়ার হিন্দুপল্লির নতুন ঘরগুলো কোনো সুখস্মৃতির স্মরণ করায় না বাসিন্দাদের।

নতুন করে তৈরি মন্দির সেখানকার মানুষদের নিরাপত্তাহীনতা আর ভয়ের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

সুনামগঞ্জের শাল্লার মতোই প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে এই পল্লিতেও হামলা হয়েছে দল বেঁধে। হামলাকারীরা ঘর ভাঙচুর করেছে, লুটপাট করেছে, আগুন দিয়েছে।

শাল্লার মতোই এই হামলার নেপথ্যেও ছিল একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস। হিন্দুধর্মাবলম্বী যুবকের সেই স্ট্যাটাসে ধর্ম অবমাননা করা হয়েছে, এমন ধুয়া তুলে মিছিল নিয়ে হয় উন্মত্ত আক্রমণ।

সে সময় তোলপাড় করা এই ঘটনায় মামলা হয় দুটি। পুলিশ প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে আদালতে। তবে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচারই শুরু করা যায়নি এখনও। এই অবস্থায় হামলার শিকার মানুষরা ক্ষুব্ধ, ভীত, সন্ত্রস্ত।

বুধবার শাল্লায় হামলার পরদিন উত্তরের মহানগরের পাগলাপীরের ঠাকুরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় পুড়িয়ে দেয়া ঘরগুলো গড়ে উঠেছে নতুন করে। ভেঙে ফেলা মন্দিরও সংস্কার করা হয়েছে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজিয়েছে।

তবে মনোবল এখনও শক্ত হয়নি তাদের। ক্ষণে ক্ষণে সেই ভয় তাড়া করে বেড়ায় তাদের।

তবে সাড়ে তিন বছর আগের আগুনের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। বাড়িতে, উঠানে, গাছের ডগায় ডগায় এখনও রয়ে গেছে সেই স্মৃতি।

গাছের ডগায় এখনও স্পষ্ট আগুনের ক্ষত

সেখানে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত সিতু রামের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে। আমরা সবাই ভালো থাকপের চাই, ভালোভাবে চলমো। হামরা কিচু টাকাপয়সা পাইচি সেইল্লা দিয়ে ঘরতুলচি কিছু ঘরের জিনিসপত্র করছি।’

হামলার বর্ণনা দিয়ে বিধান রায়ের স্ত্রী ভারতী রানী বলেন, ‘সেদিন মেলা মানুষ মিচিল নিয়ে আসছিল। হামরা ভাবছি আস্তা দিয়ে যাইবে। আস্তা দিয়ে না যায়া দোলা দিয়ে নামিল। নামিয়ে তো বাড়িঘর ভাঙচুর শুরু করিল, আগুন নাগি দেইল (আগুন ধরিয়ে দিল)। তখন আমরা ভয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে চলি যাই।’

এখনও ভয় কাটেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সারা দিন ভালো থাকি, আইত (রাত) হলে বেশি ভয় লাগে। মনে হয় এখনো যদি ওমরা আইসে। আইত (রাত) হইলে ভালোভাবে ঘুমাইতে পারিনে। খুব ভয় থাকে অন্তরটাত।’

ছবিতা রানী রায় বলেন, ‘এখনো ভয় লাগে, কখন আইসে কী হয়। ওমরা অনেকে জেলে গেছে ক্ষেপে তো আছে। অনেকেই হুমকি দেয়, তোমার বাড়িত আগুন নাগে দেমো, তোমার কারণে আমরা জেলোত গেছি এইলা কতা কয়।’

পুলিশ যেন মাঝেমধ্যে ঘুরে যায়, এটা চাইছেন ছবিতা। বলেন, ‘আগে তো প্রশাসন ছিলো এখন নাই। প্রশাসন থাকলে ভয় নাগে না। প্রশাসন দিলে ভালো হইলো হয়।’

নতুন করে ঘরবাড়ি উঠলেও ভয় কাটেনি স্থানীয়দের

বয়োবৃদ্ধ কৌশুল্লে বালা বলেন, ‘হামরা সাহায্য টাহায্য চাই না। হামরা নিরাপত্তায় থাকমো সেটাই হামরা চাই। আর যেন ভয় টয় নাগে না। কোনো মানুষ যেন কিছু করে না। হামরা আগোত যেমন আছিনু অমন থাকপের চাই।’

রংপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মধু সুদন রায় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঠাকুরপাড়ার ঘটনায় পুলিশ এখনও সতর্ক। সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন।’

বাসিন্দারের আতঙ্কিত না হবার পরামর্শ দেন দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আমরা সর্বোচ্চ নজরদারিতে রেখেছি। কেউ যেন কোনো ধরনের উসকানি দিয়ে সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে আমরা দৃষ্টি রাখছি।

কী হয়েছিল?

২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে রংপুরের পাগলাপীরের ঠাকুরপাড়ার খগেন রায়ের ছেলে টিটু রায় ফেসবুকে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে। এতে মহানবী (সা.) এর অবমাননা করা হয়েছে, এমন অভিযোগ এনে ৫ নভেম্বর পার্শ্ববর্তী লালচাঁদপুর গ্রামের মুদি দোকানি আলমগীর হোসেন গংগাচড়া থানায় টিটুর বিরুদ্ধে মামলা করেন।

১০ নভেম্বর শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে টিটু রায়কে গ্রেপ্তারের দাবিতে গংগাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের শলেয়াশাহ ও বালাবাড়ি গ্রাম এবং রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর গ্রামের ৮ থেকে ১০ হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বাধা দিলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ও লাঠি ছুড়তে থাকে। একদল গিয়ে ঠাকুরপাড়া গ্রামে কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আগুনে ভস্মীভূত হয় ১১টি বাড়ি। ভাঙচুর করা হয় মন্দিরও। সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হাবিবুর রহমান হাবিব নামে এক যুবক নিহত হন।

ফেসবুকে একটি ব্যঙ্গচিত্রের জেরে আগুন দেয়া হয় ঠাকুরপাড়ায়

সে সময় টিটু রায়কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন জামিনে মুক্ত।

এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা গিয়ে দ্রুত বিচারের আশ্বাস দেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারা ঘটনাস্থলে যান, ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন।

মামলার কী অবস্থা

গংগাচড়া থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক এসআই রেজাউল হক ঘটনার দিনই হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ভাঙচুরের মামলা করেন। এতে ১৫৯ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরও দুই হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়।

দুই বছর তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর রংপুর (গংগাচড়া) আমলি আদালতে ২২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। আদালত গ্রহণও করে।

রংপুর সদর থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক রফিকুল ইসলামও অন্য একটি মামলা করেন হামলার পর। হত্যা, লুটপাট অগ্নিসংযোগের অভিযোগে সেই মামলায় নাম উল্লেখ করা হয় ১৫৯ জনের, অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরও দুই হাজার জনকে।

২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সদর থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক সাইফুর রহমান ২১৫ জনের বিরুদ্ধে রংপুর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

এই মামলায় ধরা পড়ার পর নানা মেয়াদে কারগারে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে অনেকেই জামিনে আছেন। তবে ৪৪ জন এখনও পলাতক।

গংগাচড়া থানার ২২৩ আসামির মধ্যে ৪০ জন এখনো পলাতক। এই মামলারও অনেক আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে এখন বাইরে আছেন।

এই মামলায় আসামিদের মধ্যে আছেন রংপুর জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফজলার রহমান। তিনি গ্রেপ্তারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন। তিনিও উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।

রংপুর আদালতের সরকারি কৌশুলি( পিপি) আব্দুল মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, এখনও অভিযোগ গঠন করা হয়নি।

এ বিভাগের আরো খবর