বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হেফাজত জড়ো মসজিদের মাইকে, পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন

  •    
  • ১৭ মার্চ, ২০২১ ২০:০০

‘হামলাকারীদের বেশির ভাগই এসেছে দিরাইয়ের নাচনি গ্রাম থেকে। সকালে গ্রামের মসজিদে মাইকিং করে এই মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো হয়।’

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করতে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমর্থকদের জড়ো করা হয় মসজিদে মাইকিং করে।

হেফাজত নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন, তারা কেবল মিছিল করে চলে আসবেন। আর এই কথায় বিশ্বাস করে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ সতর্কতামূলক কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।

হামলার পর এখন এলাকার নিরাপত্তায় নানা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও আগের নিষ্ক্রিয়তার জুতসই কোনো জবাবই নেই কারও কাছে।

সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা হিন্দু অধ্যুষিত। উপজেলার প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ সনাতন ধর্মাবলম্বী। এর মধ্যে হবিবপুর ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামের সবাই এই ধর্মের অনুসারী। গ্রামে ঘর আছে শ খানেক। কিন্তু একটিও পাকা বাড়ি নেই। এখানকার বাসিন্দাদের সবাই পেশায় কৃষি ও মৎস্যজীবী।

এই গ্রামের এক তরুণ মঙ্গলবার হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। তাতে মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার অভিযোগ আনা হয়।

গত ১৫ মার্চ শাল্লার পাশের দিরাইয়ে সমাবেশ করে হেফাজত। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা মামুনুল ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। পরদিনই নোয়াগাঁও গ্রামের ওই তরুণের স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে।

মঙ্গলবার রাত থেকেই এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার সকালে এলাকায় বিক্ষোভের ঘোষণা দেয় হেফাজত।

উত্তেজনা আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা ফেসবুকে পোস্ট দেয়া তরুণকে রাতেই পুলিশের হাতে তুলে দেন।

তবে এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আর আতঙ্ক সত্ত্বেও ওই গ্রামের নিরাপত্তায় প্রশাসনের কোনো ‘উদ্যোগ’ ছিল না। ছিল না পুলিশের বাড়তি ‘নজরদারি’।

যে কারণে বুধবার সকালে নোয়াগাও গ্রামে হামলার সময় মামুনুল হকের অনুসারীদের কোনো রকম বাধার মুখেই পড়তে হয়নি। কয়েক হাজার মানুষ দা-লাঠিসহ মিছিল নিয়ে এসে ভাঙচুর করে ৮৭টি হিন্দু বাড়ি। এসব ঘর থেকে টাকাপয়সা-স্বর্ণালংকার নিয়ে যায় তারা।

হামলাকারীরা ঘর তছনছ করে দিয়েছে অসীম চক্রবর্তীর। তার অভিযোগ, পুলিশ আগে থেকেই ব্যবস্থা নিলে এমন তাণ্ডব ঘটত না।

হামলার পর ঘর ছাড়েন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা

স্থানীয় একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, হামলার পরও হামলাকারীদের ধরতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। বরং তাদের নির্বিঘ্নে চলে যেতে পুলিশ সহায়তা করে।

স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, হেফাজত নেতাদের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে পুলিশ সব সময় সতর্ক ছিল।

শাল্লার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল-মুক্তাদির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস ঘিরে মঙ্গলবার রাত থেকেই উত্তেজনা ছিল। উত্তেজনার খবর পেয়ে রাতেই আমরা হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বসি। তখন তারা মিছিল না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

‘এমন আশ্বাসে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু সকালে হঠাৎই মিছিল বের করে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় কারা জড়িত তা তদন্ত করে বের করা হবে।’

একই দাবি করে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা রাতে হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বসেছি। তারা মিছিল করবেন না কথা দিয়েছিলেন।

‘সকালে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যখন পুষ্পস্তবক অর্পণ করছিলাম, তখনই মিছিলের খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মিছিলকারীদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু লোক নদী সাঁতরে পার হয়ে বাড়িঘরে হামলা চালায়। তখন পুলিশের করার কিছু ছিল না।’

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের স্থানীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘রাতেই উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সকালে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল। তারপরও ওই গ্রামবাসীর নিরাপত্তায় পুলিশের আগাম ব্যবস্থা না নেয়া রহস্যজনক। পুলিশ তৎপর থাকলে এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।’

হামলায় দিরাইয়ের বাসিন্দারা, জড়ো করা হয় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে

হামলার শিকার নোয়াগাঁও ও তার আশপাশের গ্রামবাসী এবং প্রশাসনের লোকজন জানিয়েছেন, বুধবার সকালের বিক্ষোভ মিছিল ও হামলায় পাশের দিরাই উপজেলার লোকজনই বেশি ছিল।

দিরাইয়ের নাচনি, চণ্ডীপুর, সরমঙ্গল, কাশিপুর, সন্তোষপুর এবং শাল্লা উপজেলার কালিমপুর, কাশিপুর গ্রাম থেকেই এসেছিল বেশিরভাগ মিছিলকারী। এই মিছিল থেকেই কিছু লোক নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।

বাড়িঘর থেকে লুট করা হয় মালামাল

হামলাকারীরা ভাঙচুর করেছে পরিমল মজুমদারের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘ঘর ভাঙার পাশাপাশি আমার ঘরে থাকা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের টাকাগুলোও ছিনিয়ে নিয়েছে হামলাকারীরা।’

তিনি বলেন, ‘হামলাকারীদের আমি চিনতে পারিনি। আমাদের আশপাশের গ্রামের হলে চিনতে পারতাম।’

হামলার পর বিকেলে শাল্লায় যান সুনামগঞ্জের সাংবাদিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী শামস শামীম। তিনি বলেন, ‌‘হামলাকারীদের বেশির ভাগই এসেছে দিরাইয়ের নাচনি গ্রাম থেকে। সকালে গ্রামের মসজিদে মাইকিং করে এই মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানানো হয়।’

ভাঙচুরকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদও। তিনি বলেন, ‘আমরা মঙ্গলবার রাতেই পরিস্থিতি শান্ত করি। তারা মিছিল করবে না বলে আমাদের আশ্বাস দেয়। কিন্তু সকালে কিছু ছেলেপেলে এই ঘটনা ঘটায়।

১৫ মার্চ শাল্লার পাশের দিরাইয়ে সমাবেশ বক্তব্য রাখছেন হেফাজতের মামুনুল

‘মিছিলের খবর পেয়ে সকালেই আমি ঘটনাস্থলে যাই। সেখানে বিক্ষুব্ধ লোকদের উদ্দেশে বক্তব্যও রাখি। এমন সময় কিছু লোক হামলা চালায়।’

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েও হামলা ঠেকাতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে গিয়েছিল।’

আশপাশের গ্রামগুলোতেও মহড়া

নোয়াগাঁওয়ে হামলার পরও থেমে থাকেনি হামলাকারীরা। মিছিল নিয়ে তারা এগিয়ে যায় উপজেলা সদরের দিকে। এ সময় আশপাশের হিন্দুপ্রধান গ্রামগুলোতেও মহড়া দেয় তারা। এতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।

স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, উপজেলা সদরের ডুংরা গ্রামে প্রাচীন একটি মন্দির আছে। এই মন্দিরের দিকে এগিয়ে যায় মিছিলকারীরা। এ সময় হামলা প্রতিরোধে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও মন্দির ঘিরে জড়ো হন। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের লোকজন এসে হামলাকারীদের ফিরিয়ে দেয়।

ঘরে ফিরেছেন, বিশ্বাস ফিরেনি

বুধবার সকালে আচমকা হাজারো মানুষের আক্রমণে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান নোয়াগাও গ্রামের বাসিন্দারা। ভয়ে পাশের হাওরে আশ্রয় নেন তারা।

দুপুরে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নোয়াগাও গ্রামে যান। তারা আক্রান্ত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের অভয় দেন। ঘরছাড়া মানুষদের ঘরে ফিরিয়ে আনেন।

তবে ঘরে ফিরলেও এখনও ভয় কাটেনি গ্রামবাসীর। কেবল ওই গ্রাম নয়, পুরো উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

আগে যে স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তিনি বলেন, ‘এমনটি একাত্তর সালেও আমাদের এখানে ঘটেনি। একাত্তরে আমাদের বাড়িঘরে হামলা হয়নি। অথচ আজ স্বাধীতার ৫০ বছর পর আমরা হামলার শিকার হলাম।’

ধর্মে হিন্দু ওই স্কুলশিক্ষক নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সকালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎই শুনি চারদিকে চিৎকার। এরপর এমন ঘটনার কথা শুনি।’

নোয়াগাঁও গ্রামের বৃদ্ধা প্রতিমা মজুমদার বলেন, এ রকম ঘটনার কথা কেবল মানুষের মুখে শুনতাম। কিন্তু আমার জীবনে কখনো এ রকম ঘটনা দেখিনি। কেউ কখনো আমাদের হামলা বা হেয়প্রতিপন্ন করেনি। অথচ আজ একেবারে বাড়িঘর ভেঙে দেয়া হলো।

‘ঘরের পাশে আমাদের ছোট্ট একটা মন্দির ছিল, সেটিও গুঁড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা।’

প্রতিমা বলেন, ‘আমাদের কেউ হামলা করবে না। এতদিন এই বিশ্বাস ছিল। আজ সে বিশ্বাস ভেঙে গেল।’

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আক্রান্ত লোকদের আমরা বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে তাদের সহায়তা করবে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া তাদের নিরাপত্তায়ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।’

পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে গেছে। তাদের তৎপরতার জন্য হামলাকারীরা আরও বড় ধরনের তাণ্ডব চালাতে পারেনি। প্রশাসন হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে সব ধরনের চেষ্টা করেছে।

মামলা নেই, গ্রেপ্তারও নেই

নোয়াগাঁওয়ের ওই যুবকের ফেসবুকে স্ট্যাটাসের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এরপর ওই রাতেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর বুধবার সকালে পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘উপস্থিতি’তে হামলা চালানো হয়। তছনছ করে দেয়া হয় পুরো একটি গ্রাম। কিন্তু এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। কোনো মামলাও হয়নি।

স্থানীয় এক বাসিন্দার অভিযোগ, পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করার বদলে তাদের বুঝিয়ে শান্ত করাতেই অধিক মনোযোগী ছিল। ফলে প্রকাশ্যে হামলা-ভাঙচুর করা হলেও তাদের আটকের চেষ্টাই করেনি পুলিশ।

তবে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, তারা যেখানে জড়ো হয়েছিল পুলিশ সেখানে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কিছু লোক নদী পার হয়ে বাড়িঘরে হামলা চালায়।

তিনি বলেন, ‘কারা এই ঘটনার পেছনে রয়েছে তা আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল-মুক্তাদির হোসেন বলেন, পুলিশ হামলাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, যে জায়গায় ঘটনা ঘটেছে তা একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা। থানা থেকে মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে যেতেও ৮০ মিনিট লাগে। ফলে পুলিশের পক্ষে তাৎক্ষণিক কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করছে। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ এ ঘটনায় মামলাও করেনি।

এ বিভাগের আরো খবর