বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ ঠিকানা

  • আপেল মাহমুদ   
  • ১৭ মার্চ, ২০২১ ১০:২০

২৭ বছর ঢাকায় কেটেছে বঙ্গবন্ধুর। এই সময়কালে দুটি ঠিকানায় তিনি থেকেছেন সবচেয়ে বেশি সময়। এর মধ্যে পুরান ঢাকার আরমানীটোলার রজনী বোস লেনের একটি মেসবাড়ি। অপরটি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি।

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঢাকায় পা রাখেন, এ শহরে তার থাকার জায়গা ছিল না। ছয় ফুটের বেশি লম্বা, শুকনা শরীরের ত্রিশোর্ধ্ব এ তরুণ তখনই জানতেন, রাজনীতিই হতে যাচ্ছে তার চূড়ান্ত নিয়তি।

ঢাকায় পা রেখে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে তিনি সোজা হাজির হন ১৫০ মোগলটুলীর একটি বাসায়। সেটা ছিল আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দী-সমর্থিত মুসলিম লীগের ক্যাম্প অফিস। দূরদূরান্ত থেকে আসা কর্মীরা তখন সেখানেই থাকতেন। মেসের মতো।

অফিস সচিব শওকত আলী বিষয়টা দেখভাল করতেন। তার হাত ধরেই সেই অফিসে রাত কাটানোর সুযোগ পেলেন মুজিব। নিশ্চয়তা মিলল খাওয়ারও। শুরু হলো মুজিবের ঢাকার জীবন। ঔপনিবেশিক রাজধানী কলকাতা ছেড়ে শুধু নতুন এক শহরে আসা নয়, এটি ছিল রাজনীতির নতুন এক গন্তব্যের দিকে যাত্রা।

৮/৩ নম্বর রজনী বোস লেনের এ ভবনের মেসে মমিনুল হক খোকার সঙ্গে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। এই মেসের সঙ্গে তার অনেক রাজনৈতিক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

এই তরুণ ২১ বছর পর এই বাড়ি থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে এক ভাষণে স্বাধীন একটি দেশের জন্যে লড়াইয়ের ডাক দেবেন। ১৫০ মোগলটুলির ওই বাড়িতে তখনও সেই অগ্নিমুহূর্তের কোনো আভাস তৈরি হয়নি।

প্রথম ঠিকানা আরমানীটোলার রজনী বোস লেন

মোগলটুলির বাসায় বঙ্গবন্ধু বেশি দিন থাকেননি। কিছুদিন যেতেই বদলে গেলে ঠিকানা। খুব ভালো কিছুর যে সংস্থান হলো, বিষয়টা সে রকম নয়। ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার সঙ্গে আরমানীটোলার রজনী বোস লেনের এক মেসে ঠাঁই নিলেন তিনি। একটা চৌকিতে ঘুমাতেন দুই ভাই।

শেখ মুজিব ভাবেন, দলে এমন অনেক কর্মী আছেন যাদের মেসে থাকার সামর্থ্য নেই। তাই অফিস ছেড়ে ভাইয়ের কাছে এলেন তিনি।

মমিনুল হক খোকার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ সালের দিকে শেখ মুজিব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর জালাল উদ্দিন মোল্লা এবং আবদুল হামিদ চৌধুরীকে নিয়ে আরমানীটোলার ৮/৩ নম্বর রজনী বোস লেসের মেসে চলে আসেন।

এই বাসায় মুজিব অনেক দিন থাকেন।

আরমানীটোলায় হাফেজ মুসার বাড়িটি কিছুদিনের জন্যে ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের আশ্রয়স্থল। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

টুঙ্গিপাড়া থেকে সেখানে মাঝেমধ্যে স্ত্রী ফজিলাতুনন্নেছা রেনু আসতেন। মুজিব যা যা পছন্দ করতেন, তার সবকিছু ব্যাগে পুরে নিয়ে আসতেন তিনি।

অস্তরাগের স্মৃতি সমুজ্জ্বল: বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি শিরোনামের বইতে মমিনুল হক খোকা স্মৃতিচারণা করেছেন এভাবে: ‘রজনী বোস লেনের মেসবাড়িটি ছিল শেখ মুজিবের মিনি অফিস। তখনকার সময় তার অনেক রাজনৈতিক সহকর্মী সেখানে যেতেন। তারা গোপন সভায় মিলিত হয়ে সাম্প্রদায়িক পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও এ দেশীয় এজেন্টদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার পথ খুঁজতেন।’

এ মেসে থাকতেই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে জয় পান মুজিব। জায়গা হয় মন্ত্রিসভায়, যা তার রাজনৈতিক জীবনের ‘ইউ টার্ন’ হিসেবে দেখা হয়।

ফলে ঠিকানাও পালটে যায়। মন্ত্রী হিসেবে সেগুনবাগিচার সরকারি বাসভবন হয় তার নতুন আবাস। সরকার গঠনের ৫৬ দিনের মাথায় তা ভেঙে দেয়া হলে আর থাকা হয়নি সে বাড়িতে। এ বাড়ি থেকে মুজিব গ্রেপ্তার হলে তার পরিবারকে সরকারি বাসভবন থেকে জোর করে বের করে দেয়া হয়।

তখন পরিবারটির মাথার ওপর ছাদ তো দূরের কথা, কোনো খড়কুটোও নেই। এখানে-সেখানে ঘুরে ঠাঁই হয় নাজিরাবাজারে মোহাম্মদ হানিফের বাসায়। এরপর আওয়ামী লীগ নেত্রী আমেনা বেগমের সহযোগিতায় এক নির্মাণাধীন বাড়ি হয় মুজিব পরিবারের ঠিকানা। নির্মাণকাজের ঝক্কিঝামেলায় সেখানে থাকা হয় না বেশি দিন।

মুজিব কারাগারে থাকায়, তার পরিবারকে কেউ ভাড়া দিতে চাইতেন না। কারণ, পুলিশি হয়রানির মুখে পড়তেন বাড়ির মালিক। ওই সময়ের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম গ্যারান্টার হলেও বাসা ভাড়া পাননি।

স্মৃতিবিজড়িত নাজিরাবাজারের প্রয়াত মেয়র হানিফের বাড়ি। এখানে উঠেছিল বঙ্গবন্ধু পরিবার। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

পরে মুসলিম লীগের নেতা ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগনে আজিজুল হক নান্না মিঞার অনুরোধে সেগুনবাগিচায় এক জজ সাহেবের বাসা ভাড়া পান তারা।

পাকিস্তানের ২৫ বছরে শেখ মুজিবকে ১৪ বছরই জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছিল। এ সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং তার সন্তানদের কঠিন সময় পার করতে হয়।

বঙ্গবন্ধু তখন জেলে। সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল মাঠের পাশে মাসিক ২০০ টাকায় এক পুলিশ অফিসারের বাসা ভাড়া নেন বেগম মুজিব। এতে পাকিস্তানি প্রশাসনের ওপর মহল থেকে বাড়িওয়ালাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। ছাড়তে হয় ওই বাড়ি। ঘটনাটি জানালেন কবি সুফিয়া কামালকে। তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেখানে বলেকয়ে বাসা ভাড়ার চেষ্টা করেও সফল হননি। পরে কংগ্রেস নেতা ও মন্ত্রী আশরাফ আলী চৌধুরীর সহযোগিতায় তাদের জন্য ৭৬ নম্বর সেগুনবাগিচায় ৩০০ টাকা ভাড়ায় একটি বাসা জোগাড় করা হয়।

শেষ ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২

বাসা নিয়ে এ হয়রানি আর দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা পেতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের প্লটে বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন বেগম মুজিব। ১৯৬০ সালে শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পেলে স্ত্রী রেনু রাজি করান স্বামী মুজিবকে।

বললেই তো বাড়ি তোলা যায় না! নিজের সঞ্চয় বের করলেন বেগম মুজিব। আত্মীয়স্বজনদের কাছেও করলেন ধারদেনা। তার সঙ্গে যুক্ত হলো আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধুর আয়ের একটি অংশ।

৩২ নম্বরের এ বাড়ি ছিল ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর একমাত্র নিজস্ব ঠিকানা। ছবি: সংগৃহীত

১৯৬০-৬১ সালের দিকে বাড়ি নির্মাণের একপর্যায়ে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে কিছু টাকাও ঋণ নেয়া হয়। বাড়ি বানানোর সময় কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী মুজিব পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম, তৎকালীন পিডব্লিউডির নির্বাহী প্রকৌশলী পরে পূর্তসচিব মাইনুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম ‘ওরফে পোস্টার নুরু’।

বিনা পারিশ্রমিকে বাড়ির নকশা করে নির্মাণকাজের তদারকি করতেন মাইনুল ইসলাম। নির্মাণসামগ্রী বা অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহে এগিয়ে আসেন জহুরুল ইসলাম।

নির্মাণাধীন বাড়ির সার্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন পোস্টার নুরু। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন। বাড়ি নির্মাণের সময় পোস্টার নুরু যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করে তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করেন বঙ্গবন্ধু।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে নুরুল ইসলাম প্রায়ই ক্রসওয়ার্ড লটারি খেলতেন। লটারিতে নাম-ঠিকানা দেয়া বাধ্যতামূলক বলে একদিন সেখানে মুজিবের ছোট মেয়ে শেখ রেহানার নাম দেন তিনি। সেদিনই তিনি পেয়ে যান ছয় হাজার টাকা। সেটা নিয়েই তিনি সোজা যান বেগম মুজিবের কাছে।

তার দরদভরা আবদারে বেগম মুজিব অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিজের কাছে রেখে দেন টাকাটা। বাড়ি তৈরিতে খরচও করেছিলেন ওই টাকা। পরে নুরুল ইসলামকে অনেকটা জোর করে ফেরত দিয়েছিলেন তিনি সেই অর্থ।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িতেই ঘাতকদের গুলিতে সপরিবার নিহত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

দুটি বেডরুম, একটি ড্রয়িং রুম এবং একটি গেস্টরুমের একতলা বাড়ি দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের জীবন শুরু করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার। বেডরুমের একটিতে সস্ত্রীক বঙ্গবন্ধু থাকতেন। একটিতে থাকতেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। গেস্টরুমে থাকতেন শেখ কামাল ও শেখ জামাল। কম দামি একটি বেতের সোফাসেট দিয়ে কোনো রকমে সাজানো হয় ড্রয়িং রুম। পরে এটি দোতলা করা হয়।

এ বাড়ির সঙ্গে বেগম মুজিব ও শেখ মুজিবের অনেক পরিশ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি গণভবন ও বঙ্গভবনের জৌলুস আর রাষ্ট্রীয় চাকচিক্য, সুযোগসুবিধা বাদ দিয়ে কার্পেটবিহীন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণহীন সাধারণ একটি বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন।

এ বাড়ি হয়ে ওঠে একটি জাতির সমস্ত আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্র।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সেনারা।

চার বছর পর এ বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল উশৃঙ্খল ঘাতক নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির পিতা ও তার পরিবারকে।

এ বিভাগের আরো খবর