চল্লিশের দশকের শেষ দিকে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে যেতেন, তখন তার এ যাত্রার একমাত্র বাহন ছিল স্টিমার।
টুঙ্গিপাড়ার মধুমতী নদীপাড়ের পাটগাতি লঞ্চঘাট অথবা বাঘিয়ার নদীর পাড়ের লঞ্চঘাটে নামতেন তিনি। তারপর পায়ে হেঁটে বাড়িতে যেতেন। আবার যখন ঢাকায় ফিরতেন, তখন ওই ঘাট দুটির যেকোনো একটি দিয়ে তিনি স্টিমার বা লঞ্চে উঠতেন।
লঞ্চঘাট থেকে বাড়ি যেতে যেতে পথের দুপাশে যেসব ছায়াঢাকা গ্রাম পড়ত, সেগুলো সবই শেখ মুজিবের শৈশবের দুরন্তপনার স্মৃতিবিজড়িত। বড় মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী সময়ে তার স্মৃতিচারণামূলক বই শেখ মুজিব আমার পিতা য় লেখেন: ‘আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠোপথের ধুলাবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে, কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠেঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তার ভালো লাগত।’
নারিকেল, সুপারি, বনবীথির ছায়াঘেরা মধুমতী নদীর তীরঘেঁষা সবুজ-শ্যামল গ্রাম টুঙ্গিপাড়া আর বঙ্গবন্ধু মিলেমিশে আছে। ব্রিটিশ আমলে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের এই গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। এখানেই শেষশয্যায় শুয়ে আছেন তিনি।
শেখ মুজিব বাঙালির জাতির পিতা হলেও নিজ গ্রামের মানুষের কাছে তিনি সব সময় ‘মুজিবুর’- বলছিলেন টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ বোরহান উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতেন। ঢাকা থেকে যখন গ্রামের বাড়িতে যেতেন, মিশে যেতেন গ্রামের প্রকৃতি ও গ্রামীণ খেলাধুলার সাথে। বঙ্গবন্ধু বেড়ে ওঠেন টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ জীবনপ্রবাহের মধ্যে।’
শেখ বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘বাড়ির পিছনেই বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে হিজলগাছের ছায়াতলে তিনি গ্রামের লোকজনের সাথে বসে আড্ডা দিতেন। তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনতেন।’
এই হিজলগাছের নিচে বসে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলতেন বঙ্গবন্ধু
সেই হিজলগাছটি আজও খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিয়ে। সেই পাটগাতি স্টিমার ঘাট ও টুঙ্গিপাড়া ঘাট এখন আরও ব্যস্ত দুটি নৌবন্দর। এগুলোকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ চলছে।
পাটগাতি লঞ্চঘাট
গৃহশিক্ষা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভর্তি হয়েছিলেন তাদেরই পূর্বপুরুষের গড়া প্রতিষ্ঠান জিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষাকালে স্কুলে যাবার সময় নৌকাডুবি হলে শেখ মুজিব পড়ে যান খালের পানিতে। এরপর বঙ্গবন্ধুর দাদি তার গোটা বংশের আদরের দুলালকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি।
জিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু বঙ্গবন্ধুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
বঙ্গবন্ধুর ঠিকানা হয় বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ শহরের মথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে। বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের কথা উল্লেখ করে গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মুজিব যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, সে সময় ছাত্রদের উদ্দেশে এক ভাষণ দেবার সময় তাকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এটিই ছিল তার জীবনের প্রথম গ্রেপ্তার ও হাজতবাস। পরে ছাত্রদের চাপের মুখে পুলিশ শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। সেখান থেকে আইএ পড়তে চলে যান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। টুঙ্গিপাড়া থেকে তার প্রথম দীর্ঘ বিচ্ছেদ। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। পূর্ব পাকিস্তানের যুবনেতা হিসেবে তার উত্থান ঘটতে থাকে এ সময়। তখনও মাঝে মাঝেই তিনি টুঙ্গিপাড়ায় চলে আসতেন।
শেখ মুজিবের মানসগঠনে তার শিক্ষকদের অবদানও প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় শিক্ষকদের কাছে টেনেছেন ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায়।
বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলার খেলার মাঠ
টুঙ্গিপাড়া ২৯ নং জিটি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিবরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু এই স্কুলে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত।
জাতির পিতার স্মৃতিবিজড়িত সেই স্কুলে আজকের ছোট শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধুকে। গর্ববোধ করে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তারা গড়ে তুলতে চায় নিজেদের।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামের আব্দুল হামিদ শেখ বললেন, ‘স্বদেশি আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ইংরেজদের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে মানুষ সংগঠিত হচ্ছে। নিজের অবস্থান থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেও। কারণ গ্রামের মানুষ দুবেলা খেয়ে থাকার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছিল। মুজিব তখন কেবল শৈশব থেকে কৈশোরে পা রেখেছেন। বাবা ও মা তাকে খোকা বলে ডাকতেন। তবে তারা বুঝতেন খোকা বড় হয়ে বড় কিছু হবে।’
১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর পুরোদমে রাজনীতি শুরু করেন শেখ মুজিব। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘সভা করি, বক্তৃতা করি, খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলীম লীগ আর ছাত্রলীগ।’
দিনে দিনে শেখ মুজিব বড় নেতা হতে শুরু করলেন। তবে তার জীবনধারার সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেছে। তার রাজনৈতিক জীবনের জন্য এই গ্রাম্য পরিবেশ বেশ সহায়ক হয় বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।
বাঙালির ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে চির অম্লান করে রাখতে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধকে কেন্দ্র করে টুঙ্গিপাড়ায় গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু সমাধি কমপ্লেক্স। লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এই সৌধের কারুকার্যে ফুটে উঠেছে বেদনার চিহ্ন।
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ
বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানকে জানার সুযোগ করে দিতে টুঙ্গিপাড়া সমাধি কমপ্লেক্সে গড়ে তোলা হয়েছে একটি পাঠাগার।
এ পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান যোগেন্দ্রনাথ বাড়ৈ বলেন, আধুনিক সুযোগসংবলিত এই লাইব্রেরিতে ১০ ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৮ হাজার বইয়ের এক বিশাল সমাহার। কমপ্লেক্সে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে সপ্তাহে সাত দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয় পাঠাগার।
টুঙ্গিপাড়া থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল শেখ মুজিবের। ৫৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন শেষে এখানকার মাটিতেই ফিরে এসেছেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদতবরণ করার পর পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশেই সমাহিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।