বেঁচে থাকলে আজ বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ১০১ বছর। ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে জন্ম নেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা-মা আদর করে তার নাম রেখেছিলেন খোকা। সেই খোকাই পরবর্তীতে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন, ভালোবেসে যাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। দেশ ভাগের পরপরই বাংলার ওপর উর্দু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৯ সালে তিনি নির্বাচিত হন তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক।
কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধাচরণ করায় বহুবার কারাবরণ করেছেন এই অবিসংবাদিত নেতা।
স্বাধীনতার পথে বাঙালি জাতি যে কয়েকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছে, প্রত্যেকটিতে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন ছিল তার নেতৃত্বের ফসল। তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পায়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে শুরু করে নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জাতিকে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে এই ভাষণ ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এখন বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে নামলে ওই রাতেই গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তিনি। তার নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রুখে দাঁড়ায় বাঙালি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু। বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদ প্রদত্ত জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হন।
বিবিসির এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল তার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন এই মহান নেতা।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেও। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর হৃদয় হোক রঙিন’।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
দিনের কর্মসূচি
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ দিনটি সরকারি ছুটিও। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উদযাপনে বুধবার সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে তার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রীয় নানা কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনও নানা কর্মসূচি নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ঘিরে। বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতেও দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জানান, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বুধবার থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে এসব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন পৃথক থিমভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অডিওভিজুয়াল এবং অন্যান্য বিশেষ পরিবেশনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এর মধ্যে বুধবারের থিম হচ্ছে “ভেঙেছ দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়”।’
পরদিন ১৮ মার্চের থিম ‘মহাকালের তর্জনী’, ১৯ মার্চের থিম ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা’, ২০ মার্চের থিম ‘তারুণ্যের আলোকশিখা’, ২১ মার্চের থিম ‘ধ্বংসস্তূপে জীবনের গান’, ২২ মার্চের থিম ‘বাংলার মাটি আমার মাটি’, ২৩ মার্চের থিম ‘নারীমুক্তি, সাম্য ও স্বাধীনতা’, ২৪ মার্চের থিম ‘শান্তি-মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’, ২৫ মার্চের থিম ‘গণহত্যার কালরাত্রি ও আলোকের অভিযাত্রা’ এবং ২৬ মার্চের থিম ঠিক করা হয়েছে ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর ও অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’।
এসব অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। অংশ নেয়ার কথা প্রতিবেশী পাঁচ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরও।
কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, ‘১৭ মার্চ, ২২ মার্চ এবং ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ১৭ মার্চ, ১৯ মার্চ, ২২ মার্চ, ২৪ মার্চ এবং ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৭ মার্চের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকবেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ্।
‘এ ছাড়া ১৯ মার্চের অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, ২২ মার্চ অনুষ্ঠানে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী, ২৪ মার্চের অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এবং ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উপস্থিত থাকবেন।’
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে নানা কর্মসূচি নিয়েছে তার দল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবন, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারা দেশে দলের সব কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় দলের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ কর্মসূচি পালন করা হবে।
সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের প্রতিনিধিদল। সেখানে দোয়া এবং মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২১ মার্চ আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বক্তব্য দেবেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ ছাড়া সারা দেশের সব মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে। এ ছাড়া সকাল ৮টায় তেজগাঁও গির্জায়, সকাল ৯টায় মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে, সকাল ১০টায় রাজধানীর মেরুল বাড্ডার আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার ও বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে প্রার্থনা হবে।
কর্মসূচি সফলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।