বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিট পুলিশের সেবা পৌঁছাচ্ছে দোরগোড়ায়

  •    
  • ১৪ মার্চ, ২০২১ ০৮:৩১

বিট পুলিশিংয়ে যুক্ত জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আগে থেকেই থানা ও এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি পুলিশ ছিল। সেটির কর্মকাণ্ড কমে গিয়ে এখন বিট পুলিশিং জোরদার হয়েছে। এই পুলিশিংয়ের সঙ্গে নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও যুক্ত আছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

কুমিল্লার বাসিন্দা স্নাতকোত্তর এক তরুণীকে প্রায় চার বছর আগে বিয়ে করেন রাজধানীর কল্যাণপুর নতুন বাজার এলাকার এক যুবক। নববধূ হিসেবে ওই তরুণী শ্বশুরবাড়ি গিয়েই বুঝতে পারেন, তার স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। স্বামী দিনের বেলায় তাকে এড়িয়ে চলেন, রাতে ঘুমান মায়ের (শাশুড়ি) সঙ্গে।

এ নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য, ধীরে ধীরে যা রূপ নেয় পারিবারিক বিরোধে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর উপক্রম হলে স্থানীয় কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশের সহায়তায় ৪ মার্চ বিবাহবিচ্ছেদ হয় দুজনের। দুই পরিবারই বিট পুলিশের মধ্যস্থতায় এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। ফলে থানায় মামলা করতে বা আদালতে যেতে হয়নি কোনো পক্ষকেই।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মেয়েটি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যরা ছেলের সম্পর্কে ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়েই বিয়ে দিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলাও যাচ্ছিল না। কোর্টকাচারি করাও ছিল কঠিন। তাই বিট পুলিশের সহায়তায় বিষয়টি গোপনেই মীমাংসা করা হয়।’

কল্যাণপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মিরপুর থানা এলাকার কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশের সভাপতি দেওয়ান আবদুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেয়েটি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিল। বিষয়টি জানতে পেরে আমিসহ বিট পুলিশের কর্মকর্তা, কাজি ও দুই পরিবারের প্রতিনিধিরা বসে সমাধান করে দিই।’

তিনি বলেন, ‘দুই পরিবারের সম্মতিতে ছেলের পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিয়ে “খোলা তালাকের” মাধ্যমে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলি। ভবিষ্যতে যাতে কোনো পক্ষ কারও ক্ষতি না করে সে বিষয়ে স্ট্যাম্পে লিখিত নেয়া হয়েছে।’

একই এলাকার (১১ নম্বর ওয়ার্ড) বাসিন্দা ১৩ বছরের এক শিশু নারী নির্যাতন মামলার আসামি হওয়া থেকেও রক্ষা পেয়েছে বিট পুলিশের মধ্যস্থতায়।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেওয়ান আবদুল মান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকার চল্লিশোর্ধ্ব এক নারীকে কটাক্ষ করেছিল প্রতিবেশী ছেলেটি। বিষয়টি নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরপর সেই নারী ওই শিশুর বিরুদ্ধে থানায় নারী নির্যাতনের মামলা করতে যান।

‘বিট পুলিশ কমকর্তারা ঘটনাটি জানতে পেরে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বসে সেই বিরোধ মিটিয়ে ফেলেন। লঘু পাপে ভয়ানক হয়রানির মধ্যে পড়তে যাচ্ছিল শিশুটি।’

এভাবেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চালু হওয়া কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশিংয়ের সুফল পাচ্ছেন নাগরিকেরা। সাধারণ ঘটনার জেরে বড় ধরনের বিরোধ বা জটিলতার আগেই সুরাহা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে অনেক এলাকায় মামলার সংখ্যাও কমেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

বিট পুলিশিংয়ে যুক্ত জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আগে থেকেই থানা ও এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি পুলিশ ছিল। সেটির কর্মকাণ্ড কমে গিয়ে এখন বিট পুলিশিং জোরদার হয়েছে। এই পুলিশিংয়ের সঙ্গে নির্দিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কমকর্তা ছাড়াও যুক্ত আছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কোথাও কোনো সমস্যা, যেমন ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, হাতাহাতি, পারিবারিক কলহ, বাড়ি নির্মাণ নিয়ে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন ধরনের বিরোধের ক্ষেত্রে জটিলতা সুরাহায় কাজ করে বিট পুলিশ। তবে নারী নির্যাতন, মাদক, ইভ টিজিংসহ ফৌজদারি কোনো অপরাধের বিষয়ে তাদের সহায়তা দেয়ার সুযোগ নেই। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে নিয়মিত মামলা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয়।

কমিউনিটি ও বিট পুলিশ

পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দেশে ১৯৯২ সাল থেকে চালু রয়েছে কমিউনিটি পুলিশিং। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে সচেতন ও আগ্রহী লোকজনকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। সেই কমিটি পুলিশের সহায়তায় এলাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।

অন্যদিকে বিট পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি থানা থেকে পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যার যার এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নেন, বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহ করেন। এলাকায় কোন ধরনের অপরাধী কতজন আছে, সে বিষয়েও খোঁজ রাখা হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আইনি সহায়তা দেয়া ছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা স্থানীয় পর্যায়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়।

১৯৯২ সালে ঢাকা মহানগরীতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় বিট পুলিশিং। গত বছর থেকে এটি সারা দেশে চালু করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী উপমহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশনস) সোহেল রানা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে বিট পুলিশিং। এতে সেবাপ্রার্থীর সেবা পাওয়ার পথ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি পুলিশও জনগণের খুব কাছে গিয়ে বিভিন্নভাবে অপরাধের পরিমাণ কমিয়ে আনার সুযোগ পাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা ধরনের ফৌজদারি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সক্ষমতা আগের চেয়ে বেড়েছে। বিশেষ করে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংগঠনের আগেই পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারছে, আসামি গ্রেপ্তারের পাশাপাশি ওয়ারেন্ট তামিলের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জঙ্গিদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া অনেক সহজ হয়ে এসেছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাজধানীসহ সারা দেশের এক লাখ ১৬ হাজার ৩৪৩টি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এসব অধর্তব্য অপরাধ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ মামলার মতো হয়রানি থেকে রক্ষা পেয়েছে। এ ছাড়া এ সময়ে মাদক, চোরাচালান খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬৫ হাজার ২৫৯ জন অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের কমিউনিটি অ্যান্ড বিট পুলিশিংয়ের সহকারী উপমহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জনসাধারণের সঙ্গে অংশীদারত্ব তৈরি ও অপরাধ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিট অফিসাররা ৬ হাজার ৪৯৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৭৫ হাজার ১৩৫টি মসজিদ ও ৬১ হাজার ৪৭৯টি মন্দির পরিদর্শন করেছেন। জনগণের সহায়তায় তারা ৩৪ হাজার ২৩০টি জরুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্রান্ত ঘটনা মোকাবিলা ও ২৬ হাজার ২৩০টি প্রতিরোধমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।’

সাভারের কাউন্দিয়া এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের এক বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়েকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছিল এক বখাটে। তার কাছ থেকে মেয়েকে নিজেই উদ্ধার করি। এরপর স্থানীয় লোকজন আপস-মীমাংসার চেষ্টা চালালে বিট পুলিশের নম্বরে ফোন দিয়ে ধর্ষককে তুলে দেই পুলিশের কাছে। ’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিট পুলিশের ইনচার্জ উপপরিদর্শক প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত মামলা গ্রহণ করে আসামিকে কোর্টে পাঠিয়েছি। শিগগিরই অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি এক ব্যক্তি তার সাবেক স্ত্রীকে ছুরি মেরে নৌকা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। বিষয়টি এলাকার লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করেছি। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই তুচ্ছ ঘটনার জেরে মারামরি হয়ে থাকে। সেসব ঘটনায় স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে মীমাংসা করে যাচ্ছি।’

বিট পুলিশিং প্রসঙ্গে সাভার থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে। এতে বড় ধরনের মারামারির ঘটনা বা দুর্ঘটনা কমে গেছে। ফলে মামলার সংখ্যাও কমেছে।’

তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ড ও ইউনিয়নভিত্তিক বিট পুলিশিং ব্যবস্থা চালু হওয়ায় ভুক্তভোগীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখন আর থানায় আসতে হয় না। তার এলাকার বিট পুলিশের কার্যালয়ে বসেই সমস্যার সমাধান পেতে পারেন।’

তবে বিট পুলিশের সঙ্গে যুক্ত রাজধানীর রমনা থানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিট পুলিশের কিছু খারাপ দিকও আছে। বিট পুলিশিং চালু হওয়ার প্রথম দিকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। তারা এলাকার বখাটেদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন।

‘কেউ কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টাও করেছেন। তবে এখন ওই অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। স্থানীয় সমস্যাগুলো পুলিশ ও আমরা মিলে সমাধানের চেষ্টা করছি।’

এ বিভাগের আরো খবর