প্রিয় সন্তান বৈমানিক হোক তা কোনোদিনও চায়নি পরিবার। কিন্তু পৃথুলা রশিদ সব সময় চেয়েছিলেন আকাশ ছুঁতে। সেই পৃথুলা এখন সব ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিন বছর আগে নেপালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন পৃথুলা।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ‘বিএস টু ওয়ান ওয়ান’।
ঘটনাস্থলেই নিহত হন ড্যাশ এইট উড়োজাহাজটির চার ক্রুসহ ৫১ আরোহী। এদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি, ২৪ জন নেপালি ও একজন চীনের নাগরিক। দুর্ঘটনায় যে ২০ জন প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন, তাদের অনেকেরই আঘাত ছিল গুরুতর।
প্রয়াত বৈমানিক পৃথুলা রশিদ।
কো-পাইলট হিসেবে পৃথুলার দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছিল এটি। তার প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও ছিল কাঠমান্ডু। ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানও এ ঘটনায় নিহত হন।
দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও প্রিয় সন্তানকে আর কখনও ছুঁতে পারেননি পৃথুলার মা রাফেজা বেগম। এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মেয়ের কবরের সামনে যান, যদি পৃথৃলার ‘মা’ ডাক শুনতে পান এ আশায়।
কেমন আছেন জানতে চাইতেই ছলছল চোখে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সন্তান ছাড়া কি কোনো মা ভালো থাকে? প্রতিদিন আসরের নামাজ শেষে এখানে আসি। মাগরিব পর্যন্ত বসে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘এই ঘা কোনোদিন শুকানোর নয়। আমার এই একটাই সন্তান। সেই ছিল আমার সম্বল। এখন আমার কিছুই নেই। কোনো মা কি বলতে পারবে, সন্তানকে ছাড়া সে ভালো আছে?’
এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মেয়ে পৃথুলার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মা রাফেজা বেগম। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
দুর্ঘটনায় যে গুটি কয়েক ব্যক্তি বেঁচে ফিরেছেন, তাদের একজন গাজীপুরের মেহেদী হাসান। ভাই-ভাবী-স্ত্রীসহ নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। এদের মধ্যে ভাবী আলমুন নাহার অ্যানি, মেহেদী হাসান ও তার স্ত্রী সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা বেঁচে ফিরলেও ফেরেননি ভাই এফ এইচ প্রিয়ক ও ভাইয়ের মেয়ে আড়াই বছরের তামারা প্রিয়ন্ময়ী।
দুর্ঘটনার পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মেহেদী ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। এখন একটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। এমন ঘটনা আর কারও জীবনেই না ঘটুক।’
এ দুর্ঘটনার পর যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে, তাতে বলা হয় উড়োজাহাজটি অবতরণের শেষ মুহূর্তে গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল। ফলে রানওয়ে থেকে একটু দূরে মাটিতে আছড়ে পরে। এর ছয় সেকেন্ডের মধ্যে এটিতে আগুন ধরে যায়। আর এতেই মারা যান ফ্লাইটের বেশির ভাগ আরোহী।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে তদন্ত কমিটি মানসিক অস্থিরতাবশত পাইলটের দিগ্ভ্রান্ত হওয়া ও পরিস্থিতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাবকে দায়ী করে। পাশাপাশি উড়োজাহাজটি অবতরণের সময় কন্ট্রোল টাওয়ার ও ককপিট ক্রুদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তিকেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মারা যান বিধ্বস্ত বিমানটির পাইলট আবিদ সুলতানও।
কাঠমান্ডুর এ দুর্ঘটনা ছিল ১৯৯২ সালের পর নেপালে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ১৬৭ জন।
নেপালের এই বিমানবন্দরটিকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোর একটি হিসেবে।
ইউএস বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, দুর্ঘটনায় নিহত সব বাংলাদেশি নাগরিককেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। তবে নেপালি আরোহীদের কেউ এখনও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাননি।
তিনি বলেন, ‘এই দুঃসহ স্মৃতি আমরা কেউই মনে করতে চাই না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’
নেপালি যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ দেয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে আইনি জটিলতা।
কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নেপালি যাত্রী যারা ছিলেন, তারা সেখানে একটি অ্যাসোসিয়েশন করে সে দেশের আদালতে একটি মামলা করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, যেহেতু নেপাল মন্ট্রিল কনভেনশনে সই করে সেটি র্যাটিফাই করেছে, তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে মন্ট্রিল কনভেনশন অনুযায়ী। কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তখন বাংলাদেশে ওয়ারস কনভেনশন অনুযায়ী চলছিল।’
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও) নিয়মানুযায়ী উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা কিংবা লাগেজ হারানোর ক্ষেত্রে দুই ধরনের কনভেনশন প্রচলিত রয়েছে। একটি হলো ১৯২৯ সাল থেকে প্রচলিত ওয়ারস কনভেনশন। আরেকটি হলো তুলনামূলক আধুনিক ১৯৯৯ সালে প্রণয়ন করা মন্ট্রিল কনভেনশন।
ওয়ারস কনভেনশনটি বর্তমান সময়ের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় বেশির ভাগ দেশই এখন মন্ট্রিল কনভেনশনকে অনুসরণ করছে।
দুর্ঘটনায় নিহত অধিকাংশ আরোহীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এরই মধ্যে দিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি ইউএস-বাংলা কর্তৃপক্ষের। ফাইল ছবি
২০১৮ সালে বাংলাদেশ অনুসরণ করত ওয়ারস কনভেনশন। কিন্তু এ দুর্ঘটনার পর মন্ট্রিল কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করা হয়। পরে সে অনুযায়ী পরিবর্তন করা হয়েছে বিমান চলাচল সংক্রান্ত আইনও। মন্ট্রিল কনভেনশনে একজন যাত্রীকে ওয়ারস কনভেনশনের থেকে কয়েক গুণ বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে।
কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এতেই মূলত জটিলতা তৈরি হয়েছে। এখন আমরা আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে তাদেরও ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দেয়া হবে।
‘আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রতিনিয়ত আহত-নিহতদের পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করছি। অনেকের পরিবারের সদস্যকে ইউএস বাংলা যোগ্যতা অনুসারে চাকরিও দিয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের পাশে থাকার।’