রাজধানীতে গত দুই মাসে বেড়েছে মশা। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে নগরবাসী। এডিস মশার উপদ্রব না থাকলেও মারাত্মক হারে বেড়েছে কিউলেক্স মশা। এ মশা চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত রোগ ছড়াতে ভূমিকা রাখে।
মশা বাড়ার কারণ
মশা বাড়ার কারণ হিসেবে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার নিউজবাংলাকে বলেন, এখন যে মশা আছে, সেটা হচ্ছে কিউলেক্স মশা। যখন অনেক দিন বৃষ্টিপাত হয় না, তখন এই মশার আধিক্য দেখা যায়। বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে পানির ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। আর পানিতে অর্গানিক ম্যাটারের (জৈবকণা) পরিমাণ বেড়ে যায়। এই অর্গানিক ম্যাটার কিউলেক্স মশার খাবার। খাবার ও বাসস্থানের সুবিধার কারণে এই সময়ে এই মশার পরিমাণ বেশি হয়।
বৃষ্টিপাত না হওয়ার ফলে পানি বিভিন্ন জায়গায় স্থবির হয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেসব জায়গায় এমন পানি জমে আছে, সেখানে কিউলেক্স মশার আধিক্য বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, শীতের পরে যে তাপমাত্রা বাড়ে তা কিউলেক্স মশার প্রজননের জন্য ভালো সময়। এ সময় ব্যাপক প্রজনন হয়ে থাকে।
কবিরুল বাশার জানান, ‘প্রতি বছর মার্চ আর ফেব্রুয়ারিতে এই কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়ে যায়। তবে এবার একটু বেশি বেড়েছে। আমি এক মাস আগে এটার একটা অনুমান দিয়েছিলাম।’
কিউলেক্স মশা। ছবি: কবিরুল বাশার
ঢাকায় রোগের আশঙ্কা নেই
এখন যে মশা দেখা যায়, তার ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই কিউলেক্স মশা। এডিস মশা নয়। কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এই মশায় ঢাকায় কোনো রোগ হয় না। তবে উত্তরবঙ্গের কিছু জেলায় ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ হয়ে থাকে। ঢাকায় এই মশার মাধ্যমে রোগের কোনো আশঙ্কা নেই। মশার কামড়ে একটু জ্বালাপোড়া করে থাকে। এটা এলার্জিজনিত সমস্যা।
এ বছর মশা বেড়েছে চার গুণ
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। আর এটি পাওয়া গেছে গবেষণার মাধ্যমে।
কবিরুল বাশার নিউজবাংলাকে বলেন, তার নিজের করা গবেষণায় তিনি দেখেছেন, রাজধানীতে গত এক বছরে মশার ঘনত্ব বেড়েছে চার গুণ। প্রতিবছর যেখানে গবেষণায় প্রতি ইউনিটে মশার লার্ভার গড় ঘনত্ব থাকে ১৫ থেকে ২০, এবার সেখানে তা ৫০-এ দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি থেকেই এটি বাড়তে শুরু করে আর ফেব্রুয়ারি ও মার্চে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। যদি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে এটি আরও বাড়তে থাকবে।
এ কীটতত্ত্ববিদ বলেন, প্রতিবছর তিনি এই গবেষণা করে থাকেন। রাজধানীর ছয়টি এলাকাকে কেন্দ্র করে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণায় তিনি মশাবাহিত রোগ ও মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করেন।
এ বছর মশার ঘনত্ব কীভাবে নির্ণয় করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজধানীর শনির আখড়া, শাঁখারীবাজার, মোহাম্মদপুর-শ্যামলী, পরীবাগ-সেন্ট্রাল রোড-শাহবাগ, উত্তরা- খিলগাঁও-বাসাবো এই এলাকাগুলোতে ‘ডিপার’ নামের একটি যন্ত্র দিয়ে মশার ঘনত্ব মাপা হয়। ডিপার পানিতে ডোবালে যতগুলো মশার লার্ভা পাওয়া যায়, তা গণনা করে মশার ঘনত্ব বের করা হয়। এভাবে প্রতিটি নমুনা এলাকা থেকে ২০০টি নমুনা সংগ্রহ করে সেটির গড় করে ওই এলাকার মশার ঘনত্ব বের করেন কবিরুল বাশার।
কবিরুল বাশার বলেন, সিটি করপোরেশন আগে থেকেই যদি এটাকে টার্গেট করে কিছু পদক্ষেপ নিত, তবে মশার উপদ্রব কমে যেতে পারত।
শুধু পদক্ষেপ না নেয়ার কারণ না অন্য কোনো কারণে মশা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মশা স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে পদক্ষেপ নিলে তা নিয়ন্ত্রণে থাকত। সিটি করপোরেশন পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে দ্রুত নেয়নি।
মশা কমাতে কী করণীয়
কবিরুল বাশার জানান, এই মাসজুড়ে মশা বাড়বে। ঝড়-বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এই মশা কমবে না। রাজধানীর নর্দমাগুলো পরিষ্কার না করলে পানির ঘনত্বের সাথে এই মশার ঘনত্ব বাড়তে থাকবে। বৃষ্টি হলে ড্রেনগুলোতে পানির স্বাভাবিক চলাচল শুরু হলে এটির প্রজননক্ষমতা কমবে। এর সাথে লার্ভিসাইড দিয়ে এই মশাকে ক্রাশ করতে হবে।
সারা বছর মশা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হলে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান কবিরুল বাশার।
তিনি বলেন, স্থায়ীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে সারা বছর কাজ করতে হবে। রাজধানীর ডোবা, জলাশয় এবং ড্রেন পরিষ্কার ও দূষণমুক্ত রাখতে হবে।
জৈবিকভাবেও মশা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে জানিয়ে তিনি গাপ্পি ফিশ, ব্যাঙ, ড্রাগন ফ্লাই এগুলোর কথা উল্লেখ করেন। প্রাকৃতিকভাবে এরা মশা খেয়ে ফেলতে পারে।
কীটনাশক সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে মশার
কীটনাশক ছিটানোর পরও মশা বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নে মশার অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনেন অধ্যাপক কবিরুল।
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক প্রজাতির মশা কীটনাশক ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের জিনগত পরিবর্তন করে থাকে। যে কীটনাশক এখন দেয়া হচ্ছে বা বিগত দুই থেকে তিন বছর ধরে দেয়া হয় সেটার বিরুদ্ধে সে সহনশীলতা তৈরি করে ফেলে। এটাকে ইনসেক্টিসাইড রেজিস্ট্যান্স বা কীটনাশক সহনশীলতা বলা হয়। একটা সময়ে এটা এদের জিনগত সহনশীলতায় পরিবর্তন নিয়ে আসে, যা পরবর্তী প্রজন্মেও ট্রান্সফার হয়।’
এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘এভাবে কিউলেক্স মশা একটা পরিবর্তিত পরিবেশে বেঁচে থাকার সামর্থ্য অর্জন করে থাকে। তবে এটা যে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে তা নয়, যে কীটনাশক দিয়ে তাকে মারা হতো, সেটার বিরুদ্ধে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
‘ফলে এখন যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে আর এই মশা মরছে না।’