বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জাহিদ হাসান। ভোরের আলস্যে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে যায় তার। থাকেন সিদ্ধেশ্বরীতে। গন্তব্য বনানী। আড়মোড়া ভেঙে রাস্তায় এসে ডাকেন উবার।
একটু অপেক্ষার পর একটি গাড়ির সন্ধান দিল উবার। ফোন করতেই চালক জানালেন, ‘টাকা ক্যাশে দেবেন নাকি বিকাশে?’ জাহিদের তখন অফিস পৌঁছানোর তাড়া। চালকের উদ্দেশে বললেন, ‘যেভাবে আপনার সুবিধা।’
আবারও প্রশ্ন এলো। এবার জানতে চাওয়া হলো, ‘কোন দিকে যাবেন?’জাহিদ বললেন, ‘বনানীর দিকে।’ তবে এই গন্তব্য পছন্দ হলো না চালকের। তাই না করে দিলেন জাহিদকে।
বেশ বিরক্ত হলেন জাহিদ। উবারে যে রিকোয়েস্ট বাতিল করে দেবেন, সেটাও হচ্ছে না।কারণ, অ্যাপটি এমনভাবে বানানো, যাত্রী যদি নিজের ইচ্ছায় কোনো রাইড রিকোয়েস্ট বাতিল করেন, সে ক্ষেত্রে তাকে জরিমানা গুনতে হয়।
অপরদিকে চালক যেতে রাজি না হলেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চান না তারা। কারণ, তাতে তার রেটিং কমে যাবে। ফলে তাড়াহুড়োর মধ্যে যাত্রীকে ক্ষতিটা মেনে নিয়ে আরেকটি উবার বা বিকল্প ব্যবস্থায় গন্তব্যে যেতে হয়।
জাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন হয়রানি যদি চলতে থাকে, তবে এই সেবা দিয়ে আমার কী লাভ হবে?’
গণপরিবহনে ভোগান্তি থেকে রক্ষা পেতে উবারসহ রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোকে স্বাগত জানিয়েছিল নগরবাসী। কিন্তু বছর কয়েকের ব্যবধানে বদলে গেছে সেই ধারণা।
যাত্রীদের অভিযোগ, উবারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে হয়রানি।
তিন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিকাশে পেমেন্ট নিতে অনীহা, লোকেশন পছন্দ না হওয়া আর যাত্রীদের রিকোয়েস্ট বাতিল করতে বাধ্য করা।
এ বিষয়ে উবারের বক্তব্য জানতে চাইলে সময়ক্ষেপণ করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য তারা দেয়নি।
দেশে রাইড শেয়ারিংয়ের শুরু ২০১৫ সালে। গণপরিবহনের হয়রানি থেকে রেহাই পেতে নগরে নতুন সুবিধা রাইড শেয়ারিংয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় যাত্রীরা। একই বছর আসে দেশি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’।
বেশি আলোচনা হয় বহুজাতিক সেবা প্রতিষ্ঠান ‘উবার’ চালু নিয়ে। অ্যাপের মাধ্যমে গাড়ি কল দিয়ে স্বল্প খরচে যেকোনো জায়গায় যাওয়ার সুবিধা রাজধানীতে ট্যাক্সির অভাব অনেকটাই পূরণ করেছিল।
তবে সেবাটির ‘মধুচন্দ্রিমা’ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একের পর এক হয়রানির অভিযোগ বাড়তে থাকে রাইড শেয়ারিং সেবার বিরুদ্ধে।
উবার কিছু পদক্ষেপ ও সুবিধা যোগ করলেও তা অল্প দিনের জন্য স্থায়ী হয়। নতুন করে অভিযোগ আসতে থাকে যখন বিকাশ অ্যাপের মাধ্যমে চালকের টাকা পরিশোধের কথা বলা হয়।
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে উবারের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগগুলো স্পষ্ট হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, গন্তব্য বাছাইয়ে চালকের যথেচ্ছাচার। গন্তব্য পছন্দ না হলে চালকেরা যেতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী সরোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যাত্রীর গন্তব্যের সঙ্গে চালকের পছন্দ মেলে না। আর এতে চালক বারবার ট্রিপ ফরোয়ার্ড করতে থাকেন, যা একধরনের ভোগান্তি। এ ছাড়া চালকের অহেতুক বিরক্তি প্রকাশ ও অসদাচরণও মেনে নিতে হয়।
তিনি বলেন, ‘সেবা পাচ্ছি টাকার বিনিময়ে। তবে কেন এত ভোগান্তি হবে?’সরোয়ার আরও অভিযোগ করেন, একবার এক চালক তার এক হাজার টাকার নোট ভাঙতি দিতে পারেননি। তখন তিনি বিকাশে পেমেন্টের কথা বললে তাতেও চালক রাজি হননি। বাধ্য হয়ে তাকে দোকান থেকে কিছু কিনে টাকা ভাঙাতে হয়েছে।
মেরুল বাড্ডায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তাকরিম আহমেদ অভিযোগ করেন, ‘চালকের প্রান্ত থেকে সমস্যা হলেও যাত্রীদের ট্রিপ ক্যানসেল করতে বাধ্য করা হয়। গন্তব্যের মিল না হলে চালক ট্রিপ ক্যানসেল করতে বলেন।’
তিনি বলেন, ‘রিকোয়েস্ট পাঠালে চালক যাত্রীর গন্তব্য দেখতে পান না। তিনি গন্তব্য জানার পর যেতে না চাইলে ট্রিপ ক্যানসেল করতে বলেন, যা আমার জন্য জরিমানা। এ ক্ষেত্রে আমাকে বাধ্য হয়ে ক্যানসেল করতে হয়। এটা অনেক বড় ধরনের হয়রানি।’
গত বছর ১১ আগস্ট করোনা থেকে সুরক্ষা পেতে ক্যাশ টাকার পরিবর্তে বিকাশে পেমেন্টের কথা ঘোষণা করে উবার। তখন বলা হয়, এতে নগদ বা ভাঙতি টাকার ঝামেলা ছাড়াই রাইডের ভাড়া যাত্রীর বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ করা যাবে।
বিশেষ করে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাত্রী ও চালক উভয়কে রক্ষা করতে ক্যাশলেস এই পেমেন্ট ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়।
তবে বিকাশের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধ মানতে নারাজ চালকেরা। তাদের কথা, এই পেমেন্টের টাকা হাতে পেতে তাদের অনেক বেশি সময় লেগে যায়। ক্যাশ টাকা হাতে পেলে তাদের সুবিধা বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চালক নিউজবাংলাকে বলেন, সব চালকের ব্যবহার বা আচার-আচরণ এক হবে না। মাঝে মাঝে যাত্রীরাও গন্তব্য নিয়ে ঝামেলা করেন। তবে তারা মেনে নেন যে, বিকাশে পেমেন্ট দিলে তাদের টাকা পেতে ঝামেলা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উবারের এক চালক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো লোকেশন দেখতে পারি না। এমন অনেক সময় হয় যে দিনের শেষ ট্রিপ নেব নিজের বাসার কাছাকাছি। তখন যদি গন্তব্য না মেলে তবে ফরোয়ার্ড করে দিই।
‘এটা আমার ক্ষেত্রে হয়। অন্যদের কথা জানি না। কিন্তু লোকেশন না দেখতে পাওয়া একটা বড় সমস্যা আমাদের জন্য।’
উবার জবাব দেয় না
বাংলাদেশে উবারের নিজস্ব কার্যালয় নেই। বেঞ্চমার্ক পিআর নামে একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে উবারের কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে।
এসব অভিযোগের জবাব পেতে বেঞ্চমার্ক পিআর-এর সঙ্গে ১১ ফেব্রুয়ারি যোগাযোগ করে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয়। তখন বেঞ্চমার্ক পিআর থেকে জানানো হয়, এই প্রশ্নগুলো তারা উবারকে পাঠাবে।
এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি বেঞ্চমার্ক পিআরের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা হলে তারা উবারের ২০২০ সালের ‘ফিরে দেখা’ নামে একটি বিবৃতি পাঠায়, যেখানে সমস্যাগুলো নিয়ে কোনো উত্তর ছিল না।
বেঞ্চমার্ক পিআরের পরিচালক (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স) এ এফ এম আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, তারা প্রশ্নগুলো উবারকে পাঠিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত উবার থেকে কোনো উত্তর তারা পাননি।
কবে উত্তর পাওয়া যাবে, জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘উবার প্রশ্ন যাচাইবাছাই করে। আমরা এখান থেকে পাঠিয়েছি। ওরা বলল, আমরা দেখছি।’