১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এক অনুষ্ঠানে এসে বাংলা ভাষায় রায় দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন নামে একটি আলাদা আইনও হয়।
- আরও পড়ুন: ‘সব রায় হবে বাংলায়’
এই আইনের পর নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হলেও উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার খুব একটা হয়ে ওঠেনি। তবে বর্তমান সময়ে কিছুটা হলেও উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখা ও মামলার শুনানি বাড়ছে, যা বছর দশেক আগেও ছিল হাতে গোনা। এখন উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, কোন ভাষায় রায় বা আদেশ দেয়া হবে, তা বিচারকের এখতিয়ার। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালুর জন্য মানসিকতার পরিবর্তনের প্রয়োজন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই পদ্ধতি রাতারাতি পরিবর্তন হবে না।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতে, ব্রিটিশ শাসকদের কাছে থেকে আসা শ শ বছরে পুরোনো আইনেই চলছে আদালত। সে কারণে ইংরেজিতে মামলার ড্রাফটিংসহ (নথি তৈরি) যাবতীয় কাজ হয়ে আসছে। বিচারকরাও ইংরেজিতে রায় লিখে অভ্যস্ত। এখন এটি পরিবর্তন করতে হলে গোড়া থেকে পরিবর্তন শুরু করতে হবে। তার আগে আইনের যাবতীয় বিষয় এবং শব্দমালা বাংলায় থাকতে হবে।
এ জন্য আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলনের জন্য প্রধান বিচারপতিকে উদ্যোগ নিতে হবে। ফুলকোর্ট সভায় এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে। একই সঙ্গে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিধিবিধানেও পরিবর্তন আনতে হবে। না হলে উচ্চ আদালতে সর্বত্র বাংলা চালু হওয়া কঠিন।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে কয়েক বছর ধরে বাংলায় শুনানি গ্রহণের পাশাপাশি রায় এবং আদেশও বাংলায় দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ও ৪০ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার সম্প্রতি দেয়া রায়টিও সম্পূর্ণ বাংলায় দেয়া হয়েছে।
হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চুয়াল বেঞ্চ বাংলায় এই রায় ঘোষণা করেন। এ ছাড়া ১৮ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধর্ষণ-সংক্রান্ত একটি আলোচিত মামলার শুনানি বাংলায় হয়েছে হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে।
আইনবিশারদেরা বলেন, বাংলা ভাষায় বিচার কার্যক্রম ও রায় দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা বাংলা প্রতিশব্দ ও পরিভাষার অভাব। তবে সম্প্রতি আইন কমিশন একটি ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের উদ্যোগে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলা পরিভাষা নিয়ে মুদ্রিত হয়েছে ‘আইন-শব্দকোষ’ নামে একটি গ্রন্থ।
এ ছাড়া ইংরেজিতে লেখা রায় ও আদেশ বাংলায় অনুবাদ করতে ‘আমার ভাষা’ নামে একটি সফটওয়্যার উদ্বোধন করা হয়েছে সম্প্রতি। এটি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ এখন থেকে সহজেই বাংলায় রায় বা আদেশ পাবেন। সব মিলিয়ে উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘অনেক আগে থেকে স্বাভাবিক রীতিতে উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে এখন অনেক বিচারপতি বাংলায় রায় দিচ্ছেন, এটা ভালো দিক।’
উচ্চ আদালতের কার্যক্রমে বাংলা ভাষার প্রচলন আরও বাড়বে বলে আশা করেন তিনি বলেন, ‘আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবীরা বাংলায় যুক্তি উপস্থাপন করছেন। বিচারপতিরা বাংলায় জবাব দিচ্ছেন।’
বাংলা ভাষার ব্যবহার ও ভাষাশহিদদের মর্যাদা রক্ষায় উচ্চ আদালতে রিট দায়েরকারী আইনজীবী ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত থেকেও এখন বাংলায় রায় আসছে। এটা পজেটিভ দিক। অনেক আইনজীবীও এখন বাংলায় শুনানি করেন।
‘তবে এখনও পুরোপুরি বাংলায় রায় দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। তার কারণ অনেক আইন ও রেফারেন্স ইংরেজিতে। মামলার ড্রাফটিং করতে হয়ে ইংরেজিতে। সব মিলিয়ে চাইলেই সব বাংলায় এখনই করা সম্ভব নয়।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে শতাধিক বিচারকের মধ্যে বর্তমানে ১৩ জন কম-বেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। ছবি: সংগৃহীত
সর্বত্র বাংলা ভাষা চালুর দাবিতে রিটকারী আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী আকন্দ নিউজবাংলাকে জানান, উচ্চ আদালতে যেমন সর্বত্র বাংলা চালু নেই, তেমনটি সর্বত্র বাংলা ভাষার চালুর দাবিতে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের আদেশের তেমন কার্যকর প্রভাব পড়েনি।
‘এই ভাষার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। অথচ আমরা বাংলা ব্যবহার করতে ইতস্তত করি। বাংলায় আবেদন নিয়ে গেলে এখনও অনেক কোর্ট উৎসাহ দেয় না। তবে কোনো কোনো জজ বাংলা ব্যবহার করছেন। সর্বত্র বাংলা চালু করতে হলে সরকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।’
বাংলায় রায় ও আদেশের বিষয়ে নতুন প্রজন্মের আইনজীবীদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে বলেও মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতে শতাধিক বিচারকের মধ্যে বর্তমানে ১৩ জন কম-বেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। এর মধ্যে নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দিচ্ছেন হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন। তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন।
এরপরই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তিনি দুই হাজারেরও বেশি রায় ও আদেশ দিয়েছেন বাংলা ভাষায়। নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে দেয়া রায়টিও তিনি বাংলায় দিয়েছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়েছেন। তারা হলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ৯০-এর দশকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্য অনুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ‘নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন।
একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন।