বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলা একাডেমির অভিধানে ‘ভৌতিকভাবে’ ঢুকছে নতুন শব্দ

  •    
  • ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ২১:৫২

নতুন যুক্ত হওয়া ‘২৫০-৩০০ শব্দ’-এর মধ্যে মাত্র দুটি শব্দ স্মরণ করতে পেরেছেন একজন সম্পাদনা সহযোগী। অবশ্য এই দুটি শব্দ ‘সেলফি’ ও ‘ফেসবুক’ ২০১৬ সালের প্রথম সংস্করণ, নাকি পরের কোনো সংস্করণে অভিধানে যোগ হয়েছে, সেটি তার মনে নেই।

বাংলা একাডেমির অভিধানের প্রতিটি সংস্করণেই যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন শব্দ। তবে কোন প্রক্রিয়ায় এসব শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করছে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। সুনির্দিষ্ট নিয়ম ছাড়াই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দে বাছাই হচ্ছে নতুন শব্দ।

সবশেষ সংস্করণে কতটি নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, সে বিষয়ে নেই কোনো তথ্য বা নথি। এমনকি সম্পাদনায় জড়িতরাও জানেন না কেন ও কীভাবে এসব শব্দ ঠাঁই পেয়েছে অভিধানে। এমন ‘ভৌতিক’ অবস্থায় প্রকাশ হচ্ছে বাংলা একাডেমির অভিধানের নতুন নতুন সংস্করণ।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধান। এর সবশেষ ‌‘পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ’-এর তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে।

স্বাভাবিকভাবেই অভিধানের সবশেষ সংস্করণে নতুন কতটি শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার হিসাব থাকার কথা বাংলা একাডেমির কাছে।

বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ও আধুনিক বাংলা অভিধানের প্রকাশক ড. জালাল আহমেদও এতদিন ‘ভাবছিলেন’ এসব শব্দের তালিকা হয়ত অভিধানের ভূমিকা অংশে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে নিউজবাংলার প্রতিবেদকের কাছে যখন তিনি জানলেন পুরো অভিধানের কোথাও এই তালিকা নেই, তখন খানিকটা ‘অপ্রস্তুত’ অভিধানের প্রকাশক।

ড. জালাল আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‌‘থাকা তো উচিত ছিল। থাকলে ভালো হতো। এখন তো আমি পদাধিকার বলে প্রকাশক। যেহেতু পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে আমি ওই বিভাগের পরিচালক, আমাকে একটু সময় দেন; আমাদের যেসব সহকর্মী এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সে সময়ে, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানাব।’

তবে পরেও আর এ বিষয়ে কিছু জানাননি ড. জালাল আহমেদ।

বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মোবারক হোসেনের কাছেও বিষয়টি জানতে চেয়েছে নিউজবাংলা। তিনি স্বীকার করেন, ‘একাডেমির কাছে এ বিষয়ক কোনো তালিকা নেই।

তিনি বলেন, ‘বলা কঠিন, ঠিক কতগুলো নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিত কোনো তালিকা বা তথ্য নেই।’

‌‘প্রযুক্তিগত অনেক নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে এই অভিধানে’, এমন একটি বক্তব্য অবশ্য দিয়েছেন মোবারক হোসেন, তবে সেই শব্দের একটিও তিনি ‘মনে করতে’ পারেননি।

নতুন শব্দ যোগ হওয়ার দাবি করেছেন অভিধানের সম্পাদনা সহযোগী ও বাংলা একাডেমির বিক্রয় ও বিপণন উপবিভাগের সহপরিচালক একেএম কুতুবউদ্দিনও।

তিনি দাবি করেন, ‘নতুন শব্দের বিষয়ে ওরকম আলাদা করে বলা হয় নাই, তবে কতগুলো ভুক্তি আছে সেটা অভিধানের ফ্ল্যাপে বলা আছে।’

এরপর অভিধানের ফ্ল্যাপ উল্টে-পাল্টে সে রকম কিছু না পাওয়ায় কুতুব উদ্দিন পরামর্শ দেন অভিধানের সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলার।

বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানের সম্পাদক জামিল চৌধুরী দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

তবে অভিধানের মুখবন্ধে জামিল চৌধুরীর লেখাতেও নেই ‘নতুন শব্দ’ বিষয়ক কোনো তথ্য। সেখানে তিনি অভিধান প্রণয়নে দুজন সম্পাদনা সহযোগীর নাম উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন রাজীব কুমার সাহা এবং মাইনুল হোসেন।

অভিধানের দ্বিতীয় সংস্করণের কাজ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এ দুজনের উদ্যমের ‌‘ভূয়সী প্রশংসা’ করেছেন জামিল চৌধুরী।

সেই সূত্র ধরে নিউজবাংলা যোগাযোগ করে রাজীব কুমার সাহার সঙ্গে।

নতুন শব্দের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজীব কুমার সাহা বলেন, ‘২৫০ থেকে ৩০০ শব্দ যোগ হয়েছে বাংলা একাডেমি প্রণীত সবশেষ আধুনিক বাংলা অভিধানে। তবে এর কোনো তালিকা নেই।’

রাজিব বলেন, ‌‘অ্যালফেবেটিক অর্ডারে (বর্ণমালা অনুয়ায়ী) বিভিন্ন জায়গায় শব্দগুলো ঢুকে গেছে। এই অভিধানে শব্দ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অধিকতর ব্যবহারিক বা আমরা বর্তমান সময়ে যা ব্যবহার করছি সে রকম শব্দ যুক্ত হয়েছে।’

নতুন যুক্ত হওয়া ‘২৫০-৩০০ শব্দ’-এর মধ্যে মাত্র দুটি শব্দ স্মরণ করতে পেরেছেন রাজীব কুমার সাহা। অবশ্য এই দুটি শব্দ ‘সেলফি’ ও ‘ফেসবুক’ ২০১৬ সালের প্রথম সংস্করণ, নাকি পরের কোনো সংস্করণে অভিধানে যোগ হয়েছে, সেটি তার মনে নেই।

অভিধানে নতুন শব্দ যোগ হওয়ার নির্ধারিত কোনো নীতিমালা নেই বাংলা একাডেমির। নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সম্পাদক প্যানেলের সদস্য এবং বাংলা একাডেমির অভিধান সংশ্লিষ্ট কয়েক কর্মকর্তার মর্জি ও বিবেচনাতেই অভিধানে ঠাঁই পাচ্ছে নতুন নতুন শব্দ।

নতুন শব্দ বাছাই ও সংগ্রহের পদ্ধতি জানতে চাইলে অভিধানের সম্পাদনা সহযোগী রাজীব বলেন, ‌‘আমাদের সমকালীন পত্রপত্রিকা, সমকালীন বইপত্র, কবি-সাহিত্যিক, লেখকদের নতুন নতুন রচনা থেকে কিছু শব্দ সংকলিত হয়।’

বাংলা অভিধানের আগামী সংস্করণে করোনাভাইরাসকেন্দ্রিক বেশকিছু বিদেশি শব্দের ঠাঁই পাওয়ার ইঙ্গিত রাজিবের কথায় স্পষ্ট।

তিনি বলেন, ‌‘যেমন বলতে পারি, এই যে দুর্যোগের ভিতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি; করোনাভাইরাস, এখন করোনাভাইরাস সংক্রান্ত আমরা অনেকগুলো শব্দ পেলাম। এই শব্দগুলো হয়ত ইংরেজি অভিধানে ছিল। কিন্তু এইগুলোর ব্যবহার আমরা ওইরকম ভাবে করিনি। নেক্সট এডিশন যখন হবে এ ধরনের নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হবে।’

বিভিন্ন ভাষায় নতুন শব্দ সেই ভাষার অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আগে বিস্তর গবেষণা ও জরিপ চালানো হয়। একটি শব্দ কত মানুষ, কত সময় ধরে এবং কীভাবে ব্যবহার করছে, গুরুত্ব পায় সেগুলোও। তবে এ ধরনের কোনো কিছুই ‘সময়ের অভাবে’ করে উঠতে পারছেন না বাংলা একাডেমির অভিধান সংশ্লিষ্টরা।

শব্দজরিপ চালানো প্রসঙ্গে রাজীব কুমার সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাগজে-কলমে জরিপের কথা থাকলেও ওইটা আসলে সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার কারণ হচ্ছে, এটা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমরা যতটুকু সময় নিয়ে সাধারণত অভিধান করি, সেটা আরও সময় ডিমান্ড করে। সে কারণে আমাদের একটা প্রাথমিক ফ্রিকোয়েন্সি যাচাই করা হয়। আমাদের পত্রপত্রিকা, সেমিনার সিম্পোজিয়াম, পেপার, লিফলেট ওখানে কীভাবে শব্দগুলো ব্যবহারের প্রবণতা আছে এবং নতুন কী অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটা আমরা দেখি।’

রাজীব কুমার সাহা ‘কাগজে-কলমে’ জরিপের বিধান থাকার দাবি করলেও এর কোনো কপি দেখাতে পারেননি। এই কপি চাইলে উল্টো তিনি প্রসঙ্গ বদলে বলেন, ‘বাংলা একাডেমির প্রণীত আধুনিক বাংলা অভিধানের জন্য কোনো নির্ধারিত বিধান নেই, তবে অন্য অভিধানের জন্য আছে।’

বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মোবারক হোসেন অবশ্য অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘নতুন শব্দ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জরিপ চালানো হয় না এবং এ বিষয়ে কোনো লিখিত নিয়মও বাংলা একাডেমির নেই।’

অভিধানের নতুন সংস্করণের আগে কোনো শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার আগে যে কেউ সাদা কাগজে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করতে পারেন বলে জানিয়েছেন রাজীব কুমার সাহা।

তিনি বলেন, ‘কেউ যদি নতুন শব্দ, নতুন অর্থে…, এ রকম অনেক আবেদনপত্র আমাদের এখানে জমা পড়ে অনেক সময়। সেটা আমাদের মহাপরিচালক বরাবর কেউ যদি লিখে জমা দেয় আমরা দেখি। আমরা এ রকম অনেক চিঠি পাই যে শব্দগুলো ব্যবহারের নতুন নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এগুলো পরে আমরা আমাদের অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করে নেই। আমাদের পরিষদের কমিটি দ্বারা বিবেচনা করে, যথার্থতা যাচাই করে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত একটা প্রক্রিয়া আছে।’

তবে এই শব্দগ্রহণের জন্যও উন্মুক্ত কোনো আহ্বান বাংলা একাডেমি কখনও জানায়নি বলে স্বীকার করছেন একাডেমির কর্মকর্তারা।

শব্দ জরিপ ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে শব্দ আহ্বানের বিষয়কে অবশ্য ‘সুন্দর চিন্তা’ মনে করছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মোবারক হোসেন নিউজবাংলা প্রতিবেদকের জিজ্ঞাসার প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আপনাদের নতুন সুন্দর এই ভাবনাগুলো নিয়ে আমরা আগামীতে এগোব।’

বাংলা একাডেমির এমন অবহেলায় রীতিমতো বিস্মিত ভাষাবিদ ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ।

তিনি বলেন, ‘এই হিসাব (নতুন শব্দ) থাকা তো উচিত বটেই। আসলে ওরা এত তাড়াতাড়ি করে সব জিনিসগুলো তৈরি করে, খুবই তাড়াতাড়ি করে। আর ওদের মেথডটা (পদ্ধতি) জানি না। দুটো অভিধান তৈরি করেছে, নিজেরা বসে বসে মোটামুটি অন্যদের দিয়ে দেখিয়ে নিয়ে সেগুলো সংশোধন করেছে।’

বাংলা একাডেমির ‘দায়সারা’ কাজের উদাহরণ টেনে ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ‘বাংলা একাডেমি এক সময় ছোটদের অভিধান বের করেছিল। সেখানে ওদের এন্ট্রি (অন্তর্ভুক্তি) হচ্ছে সাপ, অর্থ দিচ্ছে সর্প। মানে আরও কঠিন করছে তারা। এটা তো অর্থ হলো না। এইটা প্রতিশব্দ হলো।’

এ বিভাগের আরো খবর