পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার দুই ইউনিয়ন কালিয়াগঞ্জ ও বড়শশীর লক্ষাধিক মানুষ দীর্ঘদিন নৌকায় করে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট দিয়ে নদী পার হয়েছে। ঐতিহাসিক বদেশ্বরী মন্দির এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যভূমি বারুনী স্নানঘাট এই এলাকায় হওয়ায় অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও আউলিয়ার ঘাট দিয়ে নদী পার হয়েছে।
আউলিয়ার ঘাট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে করতোয়ায় মিলিত হয়েছে ঘোড়ামারা নদী। তবে এই মিলনস্থলে নদী তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
গত বছর বর্ষায় ঘাটের ইজারাদাররা পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকো করে দিলেও নভেম্বরে নদীর গতিরোধ করে বাঁধ দিয়ে করেছেন দুটি রাস্তা। এর একটি দিয়ে স্থানীয়রা নদী পার হচ্ছে। আরেকটি দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে তোলা বালু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এই ঘাটের ইজারাদার তারা মিঞা আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, বোদা থানা পুলিশ এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সঙ্গে আলাপ করেই নদী ভরাট করে রাস্তা বানিয়েছেন। তাকে সহযোগিতা করেছেন মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্য মশিয়ার রহমান।
নদীতে রাস্তা নির্মাণ করায় মানুষ উপকৃত হচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।
বাংলাদেশের বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০-এ বলা হয়েছে, বালু বা মাটি উত্তোলন বা বিপণনের উদ্দেশ্যে ড্রেজিংয়ের ফলে কোনো নদীর তীর ভাঙনের শিকার হইতে পারে এইরূপ ক্ষেত্রে বালু বা মাটি উত্তোলন নিষিদ্ধ।
নদীর পারে ভাঙন ধরার বিষয়ে ইজারাদার তারা মিঞা বলেন, ‘নদীর দুই ধারে আমাদের জমি। ভাঙন ধরলে আমাদের জমি যাবে। এতে কারও কিছু যাবে আসবে না।’
ঘাটের টোল আদায়কারী নজরুল ইসলাম জানান, নদীর যেখানে মাটি, বালু ও গাছের ডালপালা দিয়ে ভরাট করা হয়েছে বর্ষা এলে তা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তখন আবার নৌকা দিয়েই মানুষ পারাপার করবে।
তিনি আরও জানান, নদী ভরাটের অভিযোগে প্রশাসনের বাধা ছিল। কিন্তু তারা মন্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন।
শুধু এখানেই নয়, করতোয়ার আরও কিছু জায়গায় বালু ও মাটি ফেলে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এতে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। হারিয়ে ফেলছে নাব্যতা।
নদীর বুকে তৈরি রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে মানুষ। ছবি: নিউজবাংলা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাড়েয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যানের ভাই আজাদ জুলফিকার একটি বালুমহালের ইজারা নেন। তারাই নদী বন্ধ করে রাস্তা তৈরি করে বালুর ব্যবসা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
করতোয়ায় ১৬টি বালুমহাল আছে। তার মধ্যে নয়টিতে ইজারাদাররা বাঁধ দিয়ে নিয়ম-নীতি না মেনে বালু তুলছেন।
তবে ইজারাদারদের দাবি, তারা জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেই নদীর গতিপথ করেছে।
বালুমহাল ইজারাদার আজাদ জুলফিকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কাজকাম তো নাই আপনাদের (সাংবাদিকদের)। নদী খননে কত দুর্নীতি হচ্ছে, সেগুলা নিয়ে লেখেন।’
এই এলাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নদী যারা বন্ধ করেছে তারা খুব প্রভাবশালী। বাঁধ দেয়ায় ধীরে ধীরে নদীটি মরে যাবে। তখন তারাই আবার দখল করবে। এই কাজটি তারা দীর্ঘমেয়াদি নদী দখলের পরিকল্পনা করেই করছেন।’
পরিবেশকর্মীদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে জেলার প্রধান নদী করতোয়া অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে।
প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘কারিগর’-এর সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘নদীটিতে বাঁধ দেয়ায় স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে করতোয়া একসময় বিলীন হয়ে যাবে অথবা গতিপথ পরিবর্তন হবে। গতিপথ পরিবর্তন হলে অনেক এলাকায় ভাঙন দেখা দেবে।’
এ বিষয়ে বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সলেমন আলী বলেন, ‘নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণের খবর আমরা পেয়েছি। সরেজমিনে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’