ভালোবাসা একটি ছোট্ট শব্দ হলেও এর মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে মনের গভীর অতল রহস্য। ভালোবাসা প্রকাশের ধরন বদলায় মানুষে মানুষে, এমনকি লিঙ্গভেদেও। আবার অনুভূতির তীব্রতা এবং প্রাপ্তিতেও আছে রকমফের।
ভালোবাসা দিবসে নিউজবাংলার বিশেষ আয়োজন ‘আমাদের প্রেম’ অনুষ্ঠানে নিজেদের ভালোবাসার গল্প বললেন দুজন ট্রান্সজেন্ডার নারী তাসনুভা আনান শিশির এবং হোচিমিন ইসলাম।
তারা দুজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক মাস্টার্স প্রোগ্রাম জেমস পি. গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার নারী শিক্ষার্থী।
নাট্যকর্মী তাসনুভার জীবনে প্রথম প্রেম আসে ২০১২ সালে। তবে সমাজ, পরিবারসহ নানা কারণে সেই প্রেম এগোতে পারেনি বেশিদূর।
নার্সিং-এ পড়াশোনা করা হোচিমিন প্রথম প্রেমে পড়েন সেই ক্লাস ফাইভে। এখনও সেই তীব্র প্রেমের অনুভূতি তাকে নাড়া দেয়। তবে কেটে গেছে সেই প্রেমের সুর। প্রিয় মানুষটির প্রতি ভালোবাসা থেকে গেলেও ঘর বাঁধার স্বপ্ন আর দেখেন না।
দুজনেই প্রেম প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে পছন্দ করেন চিঠি লেখাকে। লিখেছেন বহু চিঠি। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া চিঠির সংখ্যাও কম নয়।
এ ক্ষেত্রে তাসনুভার আছে মজার অভিজ্ঞতা। নানা হাত হয়ে চিঠি আসতে আসতে যুক্ত হয়েছে অনেক বাড়তি লাইন। এক চিঠিতে তাই পেতেন বহু মানুষের মনের কথা।
প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি কি বিয়ে?
নিউজবাংলার এমন প্রশ্নে হোচিমিন বলেন, বিয়ে করলে প্রেম আর থাকে না। তা ছাড়া বিয়ের সময় মানুষের সিদ্ধান্ত সমাজ দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়। সমাজ কী ভাবল, কীভাবে দেখল সেটা ভাবা হয়। মানুষ এগুলোকে ঊর্ধ্বে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
এর ঠিক বিপরীতটাই ভাবেন তাসনুভা। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, প্রেমের পরিণতি হওয়া উচিত বিয়ে। আর দশটা মানুষের মতো তিনিও বিয়ে করে সংসারী হতে চান। কিন্তু এই সমাজব্যবস্থায় এক জন ট্রান্সজেন্ডার নারী বা পুরুষের বিয়ের গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিয়ে তো দূরের বিষয় নিজেদের পরিবারেই তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই দূরে থেকেও যে ভালোবাসা যায় সেটিই তাদের মেনে নিতে হয়েছে।
পুরুষের শরীরে আটকে পড়া দুই নারীই মনে করেন, বাংলাদেশে জেন্ডার শিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শুধু নারী আর পুরুষের মাঝেই যে জেন্ডার সীমাবদ্ধ নয় বা মানুষের যৌনতার যে নানা ধরন রয়েছে সেগুলো অনেকে জানেনই না। তাই যথেষ্ট জ্ঞান, পরিবেশ ও সুযোগের অভাবে পরিবার, সমাজের চাপে ট্রান্সজেন্ডারদের অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়।
উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম না পাওয়ায় সবাই তাদের কথাগুলো জানাতেও পারেন না। আবার অনেক সময় নিজেদের চিনতে, বুঝতে পারলেও সামর্থ্যের অভাবে ট্রান্সজেন্ডাররা কাঙ্ক্ষিত শরীরে রূপান্তরিত হতে পারেন না। কারণ ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট, নিউরোলজিস্ট, সার্জারি এতো ধাপ পেরিয়ে যাওয়া সবার জন্য সম্ভব হয় না বলে জানান তাসনুভা।
‘Love is the most powerfull weapon in the world’ বলে মনে করেন হোচিমিন।তবে সমাজ মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবার আগেই তার লিঙ্গ, বর্ণ বিচার করা শুরু করে।
তিনি সমাজকে বলতে চান, 'মানুষকে মানুষের মতো করে মর্যাদা, ভালোবাসা দিতে হবে'।
ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি তার পরামর্শ, এই যে স্রোতের বিপরীতে তাদের পথচলায় হতে হবে কৌশলী। অপেক্ষা করতে হবে সঠিক সময়ের জন্য। এভাবেই তাদের এগোতে হবে।
ট্রান্সজেন্ডারদের গল্পগুলো, ভালো কাজগুলো তুলে আনলে মানুষের মাঝে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন হোচিমিন।
হোচিমিনের এই বক্তব্যে একমত হলেও তাসনুভার আক্ষেপ, বেশিরভাগ মানুষ তাদের গল্পগুলো দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেন।
মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন আনার কার্যকর উপায় কী?
হোচিমিন বলেন, ‘সমাজের প্রতিটা মানুষ বুকে হাত দিয়ে বলুক, ভবিষ্যতে তাদের যে সন্তান আসবে সে এক জন নারী হবে অথবা পুরুষই হবে। যদি সেটা না পারেন, যদি আপনার আগত সন্তান আমাদের মতো হয় তখন কি আপনি আপনার সন্তানের অধিকার নিয়ে কথা বলবেন? নাকি এখনই তার জন্য কথা বলা শুরু করবেন? প্রত্যেককেই তাদের অধিকারের জন্য কথা বলতে হবে।’