বয়স ৭০ পার হয়েছে। সম্পদ বলতে কিছু নেই। নেই একখণ্ড জমি। তার চেয়ে বড় কথা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করার ক্ষমতাও নেই। দুটি পা হারিয়েছেন অজানা রোগের কাছে।
তবু বিল্লাল গাজী হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে ফসল ফলান। নিজের আর স্বজনদের খাবারের ব্যবস্থা করেন, খাবার জোগান অন্যের।
তার বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনের গাঁও এলাকায়।
ফসলের মাঠে গিয়েই দেখা মেলে তার। জমির পাশেই খুলে রাখা রয়েছে তার কৃত্রিম পা।
১২ বছর আগে ধানক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে বিষাক্ত কিছুর সংস্পর্শে দুই পায়ে পচন ধরে। একটি কেটে ফেলতে হয় হাঁটুর কাছ থেকে, একটির কাটা হয় গোড়ালি থেকে। আট বছর আগে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে লাগিয়েছেন কৃত্রিম পা।
সংসারে স্ত্রীর পাশাপাশি পাঁচ সন্তান। তাদের মুখের দিকে চেয়ে অঙ্গহানির পরেও জীবনের লড়াইয়ে থেমে যেতে চাননি। অদম্য মানসিকতায় ঘুরে দাঁড়ান। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে শুরু করেন ফসলেন আবাদ।
মানুষটি চলৎশক্তি ফিরে পেয়েছেন কৃত্রিম পায়ের বদৌলতে। তবে ক্র্যাচেও ভর করতে হয় তাকে।
কাজ করার আগে পা ও ক্র্যাচ রেখে দেন জমির পাশে। ছবি: নিউজবাংলাফসলের মাঠে সেই কৃত্রিম পা খুলে আপন মনে কাজ করেন তিনি। কাজ শেষে আবার পা লাগিয়ে বাড়ি ফেরেন কষ্টসহিষ্ণু মানুষটি।
বিল্লাল এবার দুই একর জমিতে চাষ করেছেন আলু ও আখ।
মাঠে কাজ করতে করতেই নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাড়ির ধারে মাইনসের দুই একর খেত বর্গা লইয়া হেয়ানো (সেখানে) নানা রহমের আনাজ (সবজি) ও ফসল ফলাই। যেই কয় টেহা লাভ অয়, হেই দিয়া কোনোমতে সংসারের খরচ চালাই।’
বর্গা নেয়া জমিতে আখ চাষ করছেন বিল্লাল। ছবি: নিউজবাংলাতিনি বলেন, ‘অনেক পঙ্গু মানুষ আছে, যেরা অন্যের কাছে আত পাইত্যা খায়। আমি আত পাততে পারি না। আমারে দিয়া হেইডা সম্ভব না। নিজে কষ্ট কইরা উপার্জন করি, এইডার মইধ্যে এক রহম আনন্দ আছে। আল্লাহ রিজিকে যা লেইখ্যা রাহে, হেই দিয়াই কষ্টে দিন কাইট্যা যায়।’
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কামে কষ্ট অইলেও কিছু তো করার নাই। কেউ তো আর আমার কষ্ট কমায়া দিতে আইব না। নিজের কাম নিজেরই করন লাগব।’
১০ বছর ধরে অঙ্গহীন মানুষটির সরকারের ভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি পাওয়া হয়নি আর।
এর কারণ, যে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নাম-পরিচয় নিশ্চিত করা হবে, সেই কার্ডটি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। কার্ড কীভাবে আবার পাওয়া যাবে, সেটি তিনি জানেন না। আর সে চেষ্টাও করেননি।
বিল্লাল বলেন, ‘দুই পা আরায়েও (হারিয়ে) আমি পতিবন্দি (প্রতিবন্ধী) কাড পাই নাই। বয়স সত্তরের বেশি অইছে। কিন্তু আমার কপালে মেলে নাই একটা বয়স্ক ভাতা কাড। সরকারি কত সহায়তা আছে, আমি কিছুই পাই নাই। আমার একখণ্ড জমিও নাই।’
‘সরকার যদি আমারে একটা বয়স্ক বা পতিবন্দি কাড করি দিত, আমার চাষাবাদে সহায়তা করত, তাইলে পরিবার-পরিজন নিয়া একটু ভালাভাবে জীবন কাডাইতে পারতাম’- সরকারের কাছে নিজের চাওয়ার কথা জানিয়ে দিলেন বিল্লাল।
বিল্লাল গাজীর স্ত্রী আমেনা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার পঙ্গু স্বামীর এই দুর্দিনো সাহাইয্য করতে কেউই আগাই আয়ে নাই। চার ছেলের তিনজনই বিয়া করছে। হেগো অল্প আয়ে সংসারের খরচ চলে না। একমাত্র মাইয়া কলেজে পড়ে। সরকার যদি আমাগো পাশে দাঁড়াইত তাইলে আমার স্বামীর কষ্টডা কিছুডা হলেও কম অইত।’
ছেলে জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার আব্বার ভোটার আইডি কার্ড হারায়ে যাওয়ায় কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদের গিয়াও কোনো রহমের সাহাইয্য-সহযোগিতা পাই নাই।’
একমাত্র মেয়ে লিজা বাবার এই কষ্ট মানতে পারেন না। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভাবের মাঝেও অনেক কষ্ট কইরা আমারে পড়াশুনা করাইতেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম কইরা সংসার চালায়। বাবার এই কষ্ট আর সইজ্য অয় না।’
বিল্লাল তার এলাকার মানুষের কাছে অনুপ্রেরণারও নাম। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।
জীবনযুদ্ধে হার না মানা বিল্লাল। ছবি: নিউজবাংলাস্থানীয় বাসিন্দা কাওসার মিজি বলেন, ‘বিল্লাল কাকার নিকট থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। দুই পা না থাকলেও তিনি কারও কাছে হাত পাতেন না।’
সংগ্রামী মানুষটির কাহিনি চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অসীম চন্দ্র বণিককে জানালে তিনি বলেন, ‘আমরা তার সম্পর্কে জানতাম না। প্রশাসন অবশ্যই এই পঙ্গু বয়স্ক কৃষকের পাশে দাঁড়াবে। অচিরেই তাকে প্রতিবন্ধী কার্ড বা বয়স্ক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’