দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১০ বছর ধরে তদন্ত করে এমন একজনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছে, যার সঙ্গে অপরাধের কোনো সংশ্লিষ্টতাই নেই। আদালত সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচার করে ১৫ বছর সাজা ঘোষণার পর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ভুল আসামির বিরুদ্ধে।
এই পরোয়ানায় দিশেহারা নিরাপরাধ ওই ব্যক্তি শেষপর্যন্ত হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। আদালতে দুদকও স্বীকার করেছে, তাদের ‘সরল বিশ্বাসে’ চলা তদন্তে ভুল হয়েছে। হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়ে সংস্থাটি বলেছে, গ্রামের নামে সামঞ্জস্যের কারণে আসল অপরাধীর পরিবর্তে ভুল ব্যক্তির নামে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
দুদকের একই ধরনের ‘সরল বিশ্বাসে’র তদন্তের জেরে এর আগে ১ হাজার ৯২ দিন জেল খেটে মুক্তি পান নিরাপরাধ জাহালম। ২০১৯ সালে জাহালমের সাজা খাটার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। উচ্চ আদালত জাহালমকে মুক্তির আদেশ দেয়ার সময় দায়িত্বহীনতার জন্য দুদককে তিরস্কার করেছিল।
দুদকের তদন্তে একই ধরনের ভুলের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে হয়রানির শিকার নোয়াখালীর কামরুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট করার পর।
বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে রিটের পর আদালত দুদককে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়। সোমবার দুদক প্রতিবেদন জমা দিয়ে বলেছে, মামলা তদন্তের সব পর্যায়েই তাদের ভুল হয়েছে।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার আদেশ দেবে হাইকোর্ট।
রিটকারীর আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, কামরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এসএসসির নম্বরপত্র জালিয়াতির অভিযোগে ২০০৩ সালে তখনকার দুর্নীতি দমন ব্যুরো একটি মামলা করে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, কামরুল ইসলাম এসএসসির নম্বরপত্র জালিয়াতি করে এইচএসসিতে ভর্তি হন। অভিযুক্ত কামরুলের বাড়ি নোয়াখালী সদরের পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামে। বাবার নাম মো. আবুল খায়ের, মায়ের নাম ফাতেমা বেগম।
এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বদল হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রায় ১০ বছর তদন্তের পর অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর ২০১৩ সালে শুরু হয় বিচার। তবে অভিযোগপত্র দেয়া হয় পশ্চিম রাজারামপুরের পাশের পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এই কামরুল ইসলামের বাবার নাম আবুল খায়ের, মায়ের নাম রওশন আরা বেগম।
মামলা শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালে বিচারিক আদালত পূর্ব রাজারামপুর গ্রামের কামরুল ইসলামকে তিনটি ধারায় পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছর সাজা ও ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করে আদালত।
নিরাপরাধ হয়েও সাজার মুখে পড়া পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, তদন্ত বা বিচারের কোনো পর্যায়েই তিনি কিছু জানতে পারেননি। তার জন্ম ১৯৯০ সালে, আর সনদ জালিয়াতি হয়েছে ১৯৯৮ সালে।
পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলাম এখন নোয়াখালীর মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের সহকারী হিসেবে চাকরি করছেন। তিনি জানান, বাবার চাকরির সুবাদে ১৯৯৪ সালের দিকে তারা সপরিবারে পৈত্রিক ঠিকানা ছেড়ে লক্ষ্মীপুরে চলে যান। ২০০৮ সালে মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতের সহকারী হিসেবে চাকরি পান কামরুল। পরে ২০১৯ সালে ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালীতে বদলি হয়ে আসেন।
কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, লক্ষ্মীপুরে থাকার সময় নোয়াখালীর পূর্ব রাজারামপুরের ঠিকানায় দুই-একবার পুলিশ যাওয়ার খবর পেলেও সেটাকে তারা গুরুত্ব দেননি। তবে করোনা সংক্রমণের আগে গত বছরের শুরুতে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যায়। তখনই থানায় খোঁজ নিয়ে আদালতের সাজা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি জানতে পারেন।
কামরুলের আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর তিনি (কামরুল) আমাদের সাহায্য চাইলে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করি। রিটে পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করতে নির্দেশনা চাই। আদালত রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৫ নভেম্বর রুল জারি করে এবং দুদকের কাছে ঘটনার ব্যাখ্যা চায়। ’
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সোমবার দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান হাইকোর্টে তদন্ত ভুলের বিষয়টি জানান।
খুরশীদ আলম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আদালতকে বলেছি, এই কামরুল ইসলাম সেই কামরুল ইসলাম না। আরেক কামরুল ইসলামের নামে ওয়ারেন্ট গেছে, এখন সে হাইকোর্টে এসে বলেছে সে ওই কামরুল ইসলাম না। আমরাও বলেছি সে ওই কামরুল ইসলাম না।
‘আমরা পুরো ঘটনাটি তুলে ধরেছি। ক্ষমা চেয়ে বলেছি এটা ভুল হয়েছে। আদালত এ বিষয়ে রায়ের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখেছে।’
এ ঘটনাটি আরেক জাহালম কাণ্ড কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘না না। সে (কামরুল) তো জেলেই যায়নি। সে তো ট্রায়ালই ফেস করেনি। ’
ভুক্তভোগী কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, অপরাধের অভিযোগ যে কামরুলের বিরুদ্ধে তার জন্ম ১৯৭৭ সালে। ঘটনার পর তিনি বিদেশে চলে গেলেও বছর দুয়েক আগে পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামের নিজ ঠিকানায় ফিরেছেন। এখন তিনি সেখানেই আছেন।
তদন্তকারীদের দায়িত্বহীনতায় এ ঘটনার ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ করে পূর্ব রাজারামপুরের কামরুল বলেন, ‘আমার জন্ম ১৯৯০ সালে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি ২০০৬ সালে। ১৯৯৮ সালে এসএসসি নম্বরপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে, অথচ সে সময় আমার বয়স ছিল মাত্র আট বছর। আট বছর বয়সের একজন কীভাবে এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়!’