বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারাচ্ছে মাটির ঘর

  •    
  • ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:৫৮

এক সময় ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নেই শতকরা ৯০ ভাগ মানুষেরই ছিল মাটির ঘর। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ওইসব এলাকায় মাটির ঘরের জায়গায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহাসিক মাটির ঘর।

মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তন, পারিবারিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায়না। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল মানুষজন এখন পাকা দালানের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন। এতে করে দ্রুতই বিলুপ্ত হচ্ছে ‘গরীবের রাজপ্রসাদ’ খ্যাত মাটির ঘর।

এক সময় ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা বিজয়নগর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি ইউনিয়নেই শতকরা ৯০ ভাগ মানুষেরই ছিল মাটির ঘর। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় ওইসব এলাকায় মাটির ঘরের জায়গায় শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান।

বিজয়নগর উপজেলার প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, আগে উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের খাটিঙ্গা, মকুন্দপুর, দাড়িয়াপুর, কামালমোড়া, সেজামোড়া, ভিটি দাউদপুর, দুরানাল, কচুয়ামোড়া, বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, কালাছড়া, বক্তারমোড়া, ছতরপুর, দুলালপুর, পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর, শ্রীপুর, হরষপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া, পাঁচগাও, বাগদিয়া, হরষপুর, সোনামোড়া, বড়চাল, মেঘশিমুল, সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের মেরাশানী, রানুর বাজার, আলীনগর, কাঞ্চনপুনসহ বিভিন্ন গ্রামে ছিল মাটির ঘর।

বর্তমানে ওইসব গ্রামের হাতেগোনা কিছু বাড়িতে মাটির ঘর থাকলেও অধিকাংশ বাড়িতে দেখা গেছে দালান ঘর ও সেমি-পাকা টিনের ঘর।

এলাকাবাসীরা জানান, উপজেলার যেসব জায়গায় লাল মাটি ও এটেল মাটি পাওয়া যেতো সেইসব এলাকার লোকজনই বাড়িতে মাটির ঘর তৈরি করত। লাল মাটি ও এঁটেল মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে প্যাক করা হতো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগে বাড়িতে বাড়িতে দেখা যেত মাটির ঘর। ছবি: নিউজবাংলা

সেই মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো ২০/৩০ ইঞ্চি চওড়া দেয়াল। প্রতিবার ১/২ ফুট উচু করে দেয়াল তৈরি করে সেই দেয়ালকে ৫/৬ দিন রোদে শুকানো হতো। তারপর এই দেয়াল আবারও ১/২ ফুট উঁচু করে শুকানো হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০/১২ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা হতো।

তারপর এই দেয়ালের ওপর টিনের চালা বা ছন দিয়ে চালা (ছাউনি) নির্মাণ করা হতো। প্রতিটি ঘর নির্মাণ করত সময় লাগত প্রায় ২/৩ মাস। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘরের ভেতরের দিকে ধানের তুষ (কুড়া) দিয়ে দেয়ালের ওপর প্রলেপ দেয়া হয়। বাইরের দিকে দেয়া হতো চুনের প্রলেপ বা আলকাতরা। চুনের প্রলেপ দিলে ঘরের সৌন্দর্য যেমন বাড়ত, তেমনি ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও মাটির দেয়াল রক্ষা পেতো। বন্যা বা ভূমিকম্প না হলে এসব ঘর শতাধিক বছর পর্যন্ত টিকে থাকতো। যারা মাটির ঘর নির্মাণের কারিগরদের বলা হতো ‘দেয়ালি’।

উপজেলার হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামের দেয়ালী নোয়াজ আলী জানান, মাটির বাড়ি তৈরি করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে কার্তিক মাস। কারণ এ সময় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি হাত ঘর নির্মাণে ১০টাকা করে নিতাম। আবার অনেক সময় ৫/৬ হাজার টাকা চুক্তিতেও ঘর নির্মাণ করে দিতাম।

‘মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করেনা যার জন্য আমরা এই পেশা ছেড়ে দিয়েছি।’- আক্ষেপের সঙ্গে বলেন নোয়াজ।

উপজেলার নিদারাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ও তরুণ সাংবাদিক এস.এম টিপু চৌধুরী বলেন, ‘আমি ছোট বেলায় মাটির ঘরেই বসবাস করেছি। মাটির ঘরে বসবাস খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠান্ডা আর শীতের দিনে শীত লাগত না।

তিনি জানান, তাদের বাড়িতে সাতটি বড় বড় মাটির ঘর ছিল। বর্তমানে একটি ঘর ছাড়া বাকি ঘরগুলো ভেঙে সেখানে পাকা দালান নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়ির ঐতিহ্য হিসেবে এখনও প্রায় শতবর্ষ পুরনো একটি মাটির ঘর রাখা রয়েছে।

‘গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে এই মাটির ঘরটিকে আমরা রেখে দেব।’-বলেন টিপু চৌধুরী।

এখনও মাটির ঘরেই থাকেন বলে জানালেন উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. রাসেল খান।

‘আমি এখনও মাটির ঘরেই বসবাস করি। মাটির ঘরে বসবাস খুবই আরামদায়ক। গরমের দিনে ঠান্ডা আর শীতের দিনে ঘরে গরম অনুভুত হয়। আমাদের বাড়িতে পাঁচটি মাটির ঘর ছিল। এখন আমার বাড়িতে দুটি মাটির ঘর আছে। বাকি গুলে ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করা হয়েছে।’

মাটির ঘর বিলুপ্তির কারণ হিসেবে রাসেল খান জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের লোকজন বিদেশ গিয়ে এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছে। ওইসব প্রবাসীরা দেশে এসে মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করছেন।

‘রুচিবোধের পরিবর্তন, পারিবারিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায়না।’- বলেন রাসেল।

উপজেলার বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকতার হোসেন খাঁন জানান, আগে তাদের গ্রামের প্রতি বাড়িতেই মাটির ঘর ছিল। বর্তমানে মাটির ঘরের সংখ্যা একেবারেই কমে এসেছে।

তিনি বলেন, ‘লাল মাটি ও এঁটেল মাটির অভাব, মাটির ঘর তৈরি করার কারিগর সংকটের কারণে মানুষ এখন আর মাটির ঘর তৈরি করতে চায়না। এ ছাড়া গ্রামের লোকজন বিদেশে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন।

‘প্রবাসে থেকে তাদের রুচিবোধেরও পরিবর্তন হচ্ছে। প্রবাসীরা দেশে এসে তাদের পরিবারের নিরাপত্তা ও বাড়ির সৌন্দর্যের কথা ভেবে মাটির ঘর ভেঙে বিভিন্ন ডিজাইনের পাকা দালান, বহুতল বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করছেন। বাড়িতে একটি পাকা দালান থাকাটা অনেকেই স্ট্যাটাসের অংশ হিসেবে মনে করে।’

মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ায় মাটির ঘরের জায়গায় উঠছে পাকা ঘর। ছবি: নিউজবাংলা

এ ব্যাপারে বিজয়নগর উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বকুল বলেন, ‘মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। বিদেশে গিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে সামাজিক মর্যাদাবোধ ও রুচিবোধ বেড়েছে তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায়না। বাড়ির সৌন্দর্যের কারণে ও সামাজিক মর্যাদার কারণে মানুষ মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করছে।’

একই কথা বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার আবুল কালাম আজাদেরও।

‘বর্তমান সরকারের আমলে মানুষের আয়-রোজগার বেড়েছে। তা ছাড়া এলাকার অনেক মানুষ বিদেশে যাওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে। আয়-রোজগার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সামাজিক মর্যাদাবোধ ও নিজের পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি বেড়েছে। তাই মানুষ এখন আর মাটির ঘরে বসবাস করতে চায়না। সামাজিক মর্যাদার কারণে মানুষ মাটির ঘর ভেঙে পাকা দালান নির্মাণ করছে।

বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মনিরুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, ‘মানুষ এখন কর্মমুখী। মানুষের আয়-রোজগার বাড়ার কারণে মানুষ দিন দিন সৌখিন হয়ে উঠছে।

‘এ ছাড়া এলাকার প্রচুর মানুষ বিদেশ গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন। এলাকার প্রবাসীরা ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাটির ঘরে থাকতে চায়না। এ জন্য মাটির ঘর ভেঙে সুরম্য অট্টালিকা বা পাকা দালান, সেমি-পাকাঘর নির্মাণ করছেন।’

এ বিভাগের আরো খবর