সতেরো শতকের শুরুতেও আদি ঢাকার উত্তরে মিরপুর, কুর্মিটোলা, পল্টন এবং তেজগাঁও এলাকায় ছিল চারটি দুর্ভেদ্য জঙ্গল। বুড়িগঙ্গার দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর ছিল এক বিস্তৃত জলাবন। এসব বনে বিচরণ ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ, শুয়োর, কুমির, ঘড়িয়াল, অজগরসহ নানা বিচিত্র প্রাণীর।
এখন একবিংশ শতাব্দীর প্রায় সিকিভাগ পার করে এসে এসব জায়গায় কংক্রিটের অট্টালিকা। পশুপাখিরা বিদায় নিয়েছে। তবে সকলে নয়। এখনও থেকে গেছে অনেক প্রাণী।
ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ‘এনভায়রনমেন্ট অফ ক্যাপিটাল ঢাকা’ গ্রন্থে রাজধানীর গাছপালা, বন্যপ্রাণী, বাগান, পার্ক, উন্মুক্ত জায়গা ও জলাশয়সহ সার্বিক প্রাকৃতিক প্রতিবেশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। এর ‘ওয়াইল্ড লাইফ অফ ঢাকা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখকেরা সরকারি নথির বরাত দিয়ে বলছেন, ১৮০৪ সালেও ঢাকায় শিকারিরা ২৭০টি বাঘের চামড়া জমা দিয়েছিলেন পুরস্কার ও স্বীকৃতির আশায়।
এই এলাকায় জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের পরিসর আশঙ্কাজনক হারে কমে আসা এবং তার পরিণতিতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর মধ্যে সংঘাতও ছিল নৈমিত্তিক একটা ব্যাপার।
১৮৩৭ সালে পুলিশের হিসাব অনুসারে, সে সময় প্রতি বছর অন্তত এক জন করে মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা পড়ত।
এমনকি গত শতকের শুরুর দিকের সরকারি হিসাব অনুসারে, ১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে ঢাকায় ১৩টি বাঘ মারা পড়েছিল শিকারিদের হাতে।
এর ১০০ বছর পর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ঢাকা পরিণত হয়েছে প্রায় দুই কোটি লোকের এক নগরে। সুউচ্চ ভবনসহ নানাবিধ স্থাপনা, কল-কারখানা আর সারি সারি গাড়ির যান্ত্রিক চিৎকার এই শহরকে পরিণত করেছে কংক্রিটের জঙ্গলে। তবু মাঠ-প্রান্তর-সবুজহীন এই রুক্ষ নগরে এখনও টিকে আছে অনেক বন্য প্রাণ। কোনোটি স্বল্প পরিসরে। আবার অবিশ্বাস্য হলেও কোনো কোনো প্রজাতি আছে লক্ষ-কোটিতে।
প্রায় ৪৫ পৃষ্ঠার ‘ওয়াইল্ড লাইফ অফ ঢাকা’ প্রবন্ধের তিন লেখক সৈয়দ মো. হুমায়ুন কবির, ইনাম আল হক ও মো. আনোয়ারুল ইসলাম প্রবন্ধের শেষাংশে ঢাকায় এখন পর্যন্ত টিকে থাকা প্রাণীদের একটা তালিকা সংযুক্ত করেছেন। এই তালিকা ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের বরাতে ঢাকায় যেসব প্রাণীর অস্তিত্ব জানা গেছে, তা যথেষ্ট চমক জাগানিয়া।
বনরুই
ঢাকার কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের আশপাশ, মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন ও আশপাশের এলাকায় বিপন্ন তালিকাভুক্ত চায়নিজ প্যাঙ্গোলিনের দেখা পাওয়া যায়। এটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চোরাই পথে পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটা খাদ্য হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরির জন্য। এর গায়ের আঁশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাদের মাংসও চীনে একটি উপাদেয় খাবার বলে গণ্য করা হয়।
রিসাস বানর
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এদের মাঝেমধ্যেই দেখা যায় দল নিয়ে রাস্তা পার হতে। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার সাধনা ঔষধালয় এদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। খাবার যতটা খায়, নষ্ট করে তার চেয়ে বেশি। ঢাকাবাসীর অপ্রিয় সঙ্গী এরা।
পাতিশেয়াল ও খ্যাঁকশেয়াল
কুর্মিটোলা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়া মিরপুর সিরামিক ফ্যাক্টরি এলাকায় শেয়ালের দল দেখা যায়। এর ইংরেজি নাম গোল্ডেন জ্যাকেল। বাংলায় পরিচিত পাতিশেয়াল নামে। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পাতিশেয়াল ছাড়াও ঢাকায় এখনও দু-একটি খ্যাঁকশেয়াল থাকতে পারে। সুদর্শন এই প্রাণীটির মুখ সরু, খাড়া কান। স্বভাবে নিশাচর। ছয় থেকে আট বছর বাঁচে। কাঁকড়া, ইঁদুর, সাপখোপ, উইপোকা, পোকামাকড়, ফলপাকুড়, ছোট পাখি খায়।
কাঠবিড়ালি
ঢাকায় কাঠবিড়ালির বসবাস খুব বেশি দিনের না। যখন যশোর, ঝিনাইদহ থেকে ট্রাকে করে কলা আসতে শুরু করে, তখন কলার সঙ্গে এরাও এসে ঢাকায় বসতি গাড়ে। চিড়িয়াখানার খাঁচার বাইরে বোটানিক্যাল গার্ডেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।
তিন ধরনের ইঁদুর
ঢাকায় রডেনসিয়া বর্গের এই প্রাণী সংখ্যায় হয়তো মানুষের চেয়ে বেশি আছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এরাই সবচেয়ে বড় পরিবার, যা দখল করে আছে বন্যপ্রাণীর ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে আকারে বড়সর ধেড়ে ইঁদুরের দেখা মিলবে পুরান ঢাকার বড় বড় গুদাম ও স্যাঁতসেঁতে ঘরগুলোতে, যা মেঠো ইঁদুর বা খেত ইঁদুর নামেও পরিচিত।
আবার ঢাকায় মাঝারি আকারের কালো রঙের ইঁদুরও আছে যথেষ্ট। এদের শরীরের চেয়ে লেজ বড়। পৃথিবীর সব মহাদেশে এদের অস্তিত্ব আছে। প্লেগ ছড়াতে ওস্তাদ। এদের খাদ্য শস্যদানা, ফল, গাছের নরম অংশ, বীজ, পাতা, ব্যাঙের ছাতাসহ নানা মেরুদণ্ডী-অমেরুদণ্ডী প্রাণী।
এদিকে সবচেয়ে ছোট আকারের নেংটি ইঁদুরের বৈজ্ঞানিক নাম mus musculus। লম্বায় এরা তিন থেকে সাড়ে তিন ইঞ্চি। মূলত শস্যভোজী। একবারে ছয় থেকে আটটি বাচ্চা জন্ম দেয়। তাও বছরে আট থেকে দশ বার।
বেজি
ঢাকার বেজি এশিয়ার সবচেয়ে ছোট। শরীর ৩০ সেন্টিমিটার, লেজ ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা। ওজন খুব বেশি হলে ৫০০ গ্রাম। লোমের রং লালচে হলদে, নয়তো বাদামি লাল। পুরান ঢাকা, ইস্কাটন, মগবাজার, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এমনকি বনানী-গুলশানেও বেজি দেখা যায়।
বাদুড় ও চামচিকা
বড় বাদুড়ের দেখা মিলবে শহরের রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, চন্দ্রিমা উদ্যান ও বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বেশ কিছু এলাকায়। শেয়ালের সঙ্গে বিজ্ঞানীরা এর কিছু মিল নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছেন। তাই বাদুড়কে বলা হয় উড়ন্ত শৃগাল বা ফ্লাইং ফক্স। এরা মূলত ফলভোগী। আর ছোট আকারের চামচিকা হচ্ছে উপকারী বাদুড়। মূলত পতঙ্গভুক।
চিকা
চিকা বা ছুচন্দর সাদাটে বাদামি বা হালকা বাদামি পশমে আবৃত। ইঁদুরের মতো দেখতে। সুচালো মুখের চিকার লেজে ও নাকের ওপর শক্ত লোম আছে। দুর্গন্ধের জন্য এরা কুখ্যাত। শরীরের দুই পাশে তরল গন্ধথলি আছে। এই গন্ধ এত বিকট যে বিড়াল সাধারণত এদের ধরতে চায় না। সাপ ভুল করে ধরলেও ছেড়ে দেয়।
কাছিম, সাপ
ঢাকায় এখনও যে অল্পসংখ্যক পুকুর বা জলাশয় টিকে আছে তার কোনো কোনোটিতে কাছিমের দেখা পাওয়া যাবে। সাপও আছে দুই-এক প্রজাতির।
সজারু
স্তরে স্তরে সাজানো লম্বা কাঁটায় আকীর্ণ শরীরের এই প্রাণীটি রাতে চলাফেরা করে। ষাটের দশকে মিরপুর, গুলশান, বাড্ডা এবং বর্তমান উত্তরা এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে দেখা যেত। আজকাল মাঝেমধ্যে মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের আশপাশে বিপন্ন অবস্থায় ধরা পড়ে। এরা পুরোপুরি নিরামিষাশী।
শতেক প্রজাতির পাখি
পাখি বিশেষজ্ঞদের হিসাবে বর্তমানে ঢাকা শহরে শতাধিক প্রজাতির পাখি আছে। বিশেষ করে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি গড়ে ওঠায় পাখির সংখ্যা অনেক বেড়েছে।