বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্ষয়ে যাচ্ছে সাঙ্গু বন, হুমকিতে ১১৩ প্রজাতি

  •    
  • ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ১৮:৩০

বিশ্বজুড়ে বন্য প্রজাতির বৈচিত্র্যের যে ৩৪টি হটস্পট আছে, তার অন্যতম ইন্দো-বার্মা বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পট। তারই অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। এই বনে প্রাণীর আবাসস্থল আশঙ্কাজনক হারে কমছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

বান্দরবানের সাঙ্গু বনে ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর একটি মেঘলা চিতাকে হত্যা করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিকারিরা। সংরক্ষিত বনে শিকার এমনিতেই নিষিদ্ধ। তার ওপর এ প্রজাতিটি প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (আইইউসিএন) লাল তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ এটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি।

বনাঞ্চল উজাড়, খাদ্য-আবাসস্থল সংকট ও শিকারের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে সাঙ্গু বনে থাকা ১১৩ প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে বনটিতে আইইউসিএনের লাল তালিকাভুক্ত হলুদ মাথা ঢোঁড়া সাপ, বন্য গয়াল, মার্বেল চোখের বিড়াল, রামকুকুর, সূর্য ভালুকের মতো ২৫ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি বিলুপ্তির হুমকিতে।

২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রাথমিক বন্যপ্রাণী জরিপ’ চালায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ)। ২০১৬ সালের এপ্রিলে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

এ জরিপে সাঙ্গু সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে ১১৩ প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১১ প্রজাতির বিরল পাখি।

জরিপে বলা হয়, আইইউসিএনের বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষিত সাতটি বন্যপ্রাণী বান্দরবানের সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এগুলো টিকে আছে শুধু এই বনেই।

২০১৬ সালে সাঙ্গুর ২৬টি এলাকায় একটি জরিপ চালায় সিসিএ। জরিপ অনুযায়ী, শুধু ২০১৬ সালেই সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে ২০০টি হরিণ, ৫২টি বন্যশূকর, আড়াইশর বেশি বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, শতাধিক পাখি, আড়াইশর বেশি টিকটিকি শিকার করা হয়েছে।

শিকারীদের হাতে ধরা পড়া বন্যপ্রাণী। ছবি: নিউজবাংলা

সারা বিশ্বজুড়ে বন্য প্রজাতির বৈচিত্র্যের যে ৩৪টি হটস্পট আছে, তার অন্যতম ইন্দো-বার্মা বায়োডায়ভার্সিটি হটস্পটের অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। এই বনে প্রাণীর আবাসস্থল আশঙ্কাজনক হারে কমছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।

বসবাসের নিশ্চিন্ত জায়গা হারিয়ে এসব প্রাণী বাধ্য হয়ে চলে আসছে লোকালয়ে। এতে এগুলো প্রাণ হারাচ্ছে। পাচারেরও শিকার হচ্ছে বিচিত্র প্রজাতির পাখি, তক্ষকসহ নানা স্তন্যপায়ী প্রাণী।

সিসিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার সিজার রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপন্নপ্রায় ২৫ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। বন উজাড় হলে এগুলো হারিয়ে যাবে। সাঙ্গু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বন। এই বন সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগ নেয়া দরকার।

বনের ভেতর জুম চাষ ও শিকার

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি বাসিন্দাদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বন্যপ্রাণী শিকার। দুর্গম এলাকায় প্রতিকূল পরিবেশে আমিষের আর কোনো বিকল্প না থাকায় শিকার অন্যতম সংস্থান। পাশাপাশি কিছু লোকজ ওষুধ তৈরির জন্য বন্যপ্রাণী হত্যা করে সেখানকার বাসিন্দারা। এছাড়া নির্বিচারে গাছ কাটা, বিশেষ করে অপরিকল্পিত জুমের কারণে জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলায় কমছে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা।

জুম চাষের জন্য পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে পাহাড়ের আগাছা ও গাছ-গাছড়া। ছবি: নিউজবাংলা

মূলত আদিবাসীদের জুম চাষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিকারের প্রথা। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জুমিয়ারা চাষের জন্য পাহাড়ের আগাছা থেকে শুরু করে গাছ-গাছড়া পরিষ্কার করতে আগুন লাগিয়ে দেয়।

মে মাসে বৃষ্টি শুরু হতেই ফসলের বীজ বোনা হয়। পুরো বর্ষা মৌসুম ধরে চলে পরিচর্যা। এ সময় জুমিয়ারা পরিবারসহ পাহাড়ের ঢালে জুম ঘরে চলে আসে।

জুমের পাশে এ সময় ফাঁদ পেতে শিকারের আয়োজন চলে। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের শিকারের জন্য রয়েছে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি। যেমন মুরং সম্প্রদায়ের ডং, খগলাং, প্রিচেক পদ্ধতি। মূলত জুম ক্ষেতে আসা হরিণ, শূকরসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি ধরা পড়ে এসব ফাঁদে।

প্রাণী শিকারের ফাঁদ। ছবি: নিউজবাংলা

তবে শিকারের মূল মৌসুম শুরু হয় শীতে ফসল তোলা শেষে। এ সময় ব্যাপকভাবে মায়া হরিণ শিকার করা হয়। আদিম পদ্ধতি ছাড়াও নিজেদের তৈরি গাদা বন্দুক দিয়ে শিকার করা হয় বন্যপ্রাণী।

গাছ কেটে উজাড় হচ্ছে সাঙ্গু

বান্দরবানের রেমাক্রির স্থানীয় এক জন বাসিন্দা নিউজবাংলাকে জানান, সাঙ্গুর মদক ও সিঙ্গাপা মৌজায় সবচেয়ে বেশি গাছ উজাড় হচ্ছে। ওই মৌজা দুটি গহীনে অবস্থিত। সেখানে বন্যপ্রাণীর আনাগোনাও বেশি। তাই বন উজাড়ের ফলে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলো হুমকিতে পড়েছে।

বন থেকে গাছ কাটার সত্যতা পেয়েছে বনবিভাগও। ইতোমধ্যে বান্দরবান বনবিভাগ ওই দুই মৌজা থেকে দেড় হাজার ঘনফুট কেটে ফেলা গাছ উদ্ধার করেছে।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এখনও প্রায় এক হাজারের বেশি কাঠুরিয়াকে কাজে লাগিয়ে কাঠ পাচারকারীরা প্রাকৃতিক এই বনাঞ্চল ধ্বংস করেছে।

গত ৯ নভেম্বর এক বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সাঙ্গু-মাতামুহুরি অভয়ারণ্য ও সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস বন্ধ ও বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, সংঘবদ্ধ কাঠ পাচারকারীরা বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সাঙ্গু বনাঞ্চলকে ধ্বংস করছে।

এখান থেকে কাঠুরিয়াদের সরানো, বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া, সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংলগ্ন বড় মদক, ছোট মদক, রেমাক্রি ও তিন্দু এলাকায় জোত পারমিট ও কাঠ পরিবহন বন্ধ এবং এই বনাঞ্চল রক্ষায় উচ্চ পর্যায়ে একটি মাল্টি সেক্টরাল তদন্ত কমিটি করার দাবি জানানো হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে সাঙ্গু মাতামুহুরি অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়। বন বিভাগ, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর প্রায় ১২ থেকে ১৪টি চেকপোস্ট অতিক্রম করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে গাছ পাচার করতে পারা উদ্বেগের। এই বনাঞ্চল ধ্বংস হলে পরিবেশের বহুমাত্রিক বিপর্যয়সহ সাঙ্গু নদীর পানি-কাঠামোর উপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

সাঙ্গু বনে ২০টি বসতি

বান্দরবান বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে ২০টি বসতি রয়েছে। এসব বসতিতে অন্তত দুই হাজার মানুষ বসবাস করে। পাড়ার বাসিন্দারা প্রতি বছর জুম চাষের জন্য সাঙ্গু বনের গাছ কেটে ফেলে। খাবারের চাহিদা মেটাতে প্রাণী হত্যা করা হয়।

সাঙ্গু বনের ভেতর ম্রোদের পাড়া। ছবি: নিউজবাংলা

বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিয়া বলেন, সংরক্ষিত বনে মানুষের বসবাস নিষিদ্ধ হলেও যুগ যুগ ধরে পাহাড়িরা সেখানে বসবাস করে আসছে।

জুম চাষ বন্ধ চায় বনবিভাগ

বান্দরবানের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিয়া বলেন, সাঙ্গু বনে অনেক প্রাণী আছে, যেগুলো আইইউসিএনের লাল তালিকাভুক্ত। এসব বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রক্ষায় বনকে রক্ষা করতে হবে। আর বনকে রক্ষা করতে হলে বনের ভেতর জুম চাষ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি প্রাণী শিকার রুখতে হবে। আর জুমচাষীদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে দিতে হবে। এজন্য একটি রূপরেখা তৈরি করা দরকার। নয়তো সাঙ্গুর সঙ্গে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে বিপন্ন প্রজাতির এসব প্রাণী।

১৮৮০ সালে সংরক্ষিত ঘোষিত

এই বনাঞ্চল দেশের একমাত্র কুমারী বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। সাঙ্গু বনের মোট আয়তন ৮২ হাজার ৮০ একর।

পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ইদ্রিছ আলী বলেন, সাঙ্গু নদের অববাহিকায় অবস্থিত সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এখনও কুমারী বনের (ভার্জিন ফরেস্ট) অস্তিত্ব রয়েছে। সেখানে বসবাসরত বননির্ভর মানুষকে যথাযথ পুনর্বাসনের মাধ্যমে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকে বনাঞ্চলকে রক্ষা করতে হবে। বনাঞ্চল রক্ষা করা না গেলে প্রাণবৈচিত্র্যের পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

এ বিভাগের আরো খবর