দেশের ইতিহাসে কোনো সরকারেরই টানা ১২ বছর ক্ষমতায় থাকার নজির নেই। ২০০৯ সালের আগে আসা প্রত্যেক সরকারকে এক মেয়াদ শেষেই বিদায় নিতে হয়েছে। এর ফলে দেখা যায়নি দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন কার্যক্রম। এসবে ব্যত্যয় ঘটিয়েছে বর্তমান সরকার।
টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থেকে মেগা সব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে তারা। এতে উন্নয়নের সোপান বেয়ে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারছে বর্তমান সরকার। ধারাবাহিকতা থাকছে উন্নয়নে। যেসব প্রকল্প সবার নজর কেড়েছে তার মধ্যে সব মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, মেট্রোরেল, কর্নফুলী টানেল ও পদ্মা সেতু উল্লেখযোগ্য।
এর অনেকগুলোর কাজ প্রায় শেষ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময় বলেছেন, এসব মেগা প্রকল্পের বেশির ভাগের কাজই শেষ হবে ২০২২ সালের মধ্যে।
চার লেনে ৬ মহাসড়ক
সরকারের নেয়া অন্যতম বড় প্রকল্প ছিল দেশের সব মহাসড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীত করা। এরই মধ্যে শেষ হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনের কাজ। ২০১৬ সালের ২ জুলাই চার লেনের এ সড়কটি উদ্বোধন করা হয়। এখন এই সড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। চার লেনের সঙ্গে নতুন যে দুটি লেন যুক্ত হবে এ দুটি হবে এক্সপ্রেসওয়ে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুটি লেন ব্যবহার করে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াত করা যাবে। এ ছাড়াও চার লেনের কাজ চলছে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে।
সড়ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে দেশের ৬টি মহাসড়কের মোট ৪৭০ কিলোমিটার অংশ চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের প্রথম আট লেনের সড়ক হিসেবে উন্নয়ন করা হয়েছে যাত্রাবাড়ি-কাঁচপুর সড়কটিকে। এগুলোর ফলে সড়ক যোগাযোগে যেমন গতি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও।
কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে হচ্ছে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেল
চট্টগ্রামের দুপাড় যুক্ত হবে কর্ণফুলী টানেলে
চট্টগ্রামের কর্নফুলি নদীর তলদেশে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম সুরঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি টানেলের মূল নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও সেতু বিভাগ। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা।
টানেলটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গার সঙ্গে আনোয়ারাকে যুক্ত করবে। নদীর তলদেশে টানেলের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এরই মধ্যে টানেলের প্রথম টিউব নির্মাণ শেষ, এখন চলছে দ্বিতীয় টিউব নির্মাণের কাজ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই এটি দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই টানেলের ফলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমবে অন্তত ৩৪ কিলোমিটার। মূল টানেল ছাড়াও পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটারের একটি ওভারব্রিজও তৈরি করা হচ্ছে প্রকল্পটির মাধ্যমে।
ঢাকার যানজট নিরসনে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ
যানজট কমাবে মেট্রোরেল
রাজধানীতে গণপরিবহনের সমস্যা মেটাতে ২০১২ সালে শুরু হয় মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প অনুযায়ী উত্তরা থেকে মিরপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে মতিঝিল ও কমলাপুর পর্যন্ত যাবে দেশের প্রথম মেট্রোরেলটি। আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের ভায়াডাক্টের সবগুলো বসে গেছে। এখন চলছে কমলাপুর থেকে আগারগাঁও পথের ভায়াডাক্ট বসানোর কাজ। এরই মধ্যে দেশে এসেছে মেট্রোরেলের ডামি ও কোচ। করোনার কারণে বিদেশি কর্মীরা কাজ করতে না পারায় নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কিছুটা ধীরগতি এসেছে।
পুরো প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন সিদ্দিক বলেন, ‘মেট্রোরেল প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাস্তবায়নের লক্ষ্য ২০২১ সালে নামিয়ে আনা হয়েছে। তাই নতুন করে কর্মপরিকল্পনা করতে হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়নের জন্য। সেই নতুন কর্মপরিকল্পনা ধরেই সকল কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।’
এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে মেট্রোরেল চলাচল শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও জানান এম এন সিদ্দিক। পর্যায়ক্রমে রাজধানীতে আরও কয়েকটি মেট্রোরেল চালু করতে চায় সরকার।
বর্তমান সরকারের সময়ে কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ প্রেরণের মাধ্যমে মহাকাশেও জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ।
৪০ দ্বীপে আলো ছড়াচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১
২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে পাঠানো হয় দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১। আর এর মধ্য দিয়ে স্যাটেলাইট প্রেরণকারী ৫৭টি দেশের একটি হওয়ার গৌরব অর্জন করে দেশ। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু-১ মুলত একটি যোগাযোগ স্যাটেলাইট। বর্তমানে এটি দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। পাশাপাশি ডিজিটাল নানা সেবা পৌঁছে দিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে যেমন দ্বীপ কিংবা রিমোট এলাকা বা পার্বত্য এলাকায়, যেখানে ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল যায় না, সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ আমরা পৌঁছে দিতে পারি। আমরা এরই মধ্যে ৪০টি দ্বীপে যেগুলো মুল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে, তাদেরকে সার্ভিস দিচ্ছি।
‘কি ধরনের সার্ভিস দিচ্ছি, যেমন ধরেন টেলিমেডিসিন। ওই সমস্ত জায়গায় হয়তো ভালো চিকিৎসক পাওয়া যাবে না, সেখানে এখানকার চিকিৎসকদের দিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে। আরেকটি হচ্ছে টেলি এডুকেশন। সেখানে হয়তো ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা নেই, ভালো শিক্ষক নেই। কিন্তু এই পদ্ধতিতে আমরা এখানকার শিক্ষকদের দিয়ে সেখানে শিক্ষা পৌঁছে দিচ্ছি।’
প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের সফল উৎক্ষেপনের পর এবার দ্বিতীয়টি মহাকাশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে বলে জানান শাহজাহান।
সব অনিশ্চয়তা মিথ্যে প্রমাণ করে পদ্মাসেতু দৃশ্যমান করেছে বর্তমান সরকার
দৃশ্যমান পদ্মা সেতু
পদ্মার বুকে সেতু গড়ার স্বপ্ন ছিল শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম বড় একটি অঙ্গিকার। নিজস্ব অর্থায়নে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো এটি। কিন্তু প্রকল্পের শুরু থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়েছে সরকারকে। প্রকল্প শুরুর আগেই আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের। গত ১০ ডিসেম্বর সেতুর মুল কাঠামো ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার অংশে স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে সেতুর মূল অবকাঠামো এখন দৃশ্যমান।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময় বলেছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২১ সালেই সেতুতে যানচলাচল শুরু হবে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এই সেতু।