শীত মানেই খেজুরের গুড়ের পিঠা-পুলি আর সুস্বাদু পায়েস। তবে ভেজালের ভিড়ে আসল খেজুরের গুড় চেনা বেশ কঠিন। বাজারে গিয়ে খেই হারান অনেকেই, এমনকি সুপার শপ বা অনলাইনে মোহনীয় বিজ্ঞাপনেও কাটে না সংশয়।
ভেজাল এড়িয়ে আসল খেজুরের গুড় কেনার কৌশল জানাতে নিউজবাংলা কথা বলেছে যশোরের কারিগরদের সঙ্গে। তারা বলছেন, রকমারি বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হলে ঠকার সম্ভাবনাই বেশি। জেনে-বুঝে যাচাই করে কিনতে হবে এই গুড়।
অনেক সময় বেশি মিষ্টি করতে গুড়ে মেশানো হয় চিনি, রং আকর্ষণীয় করতে মেশানো হয় কৃত্রিম রঙ। এসব ফাঁদ এড়ানোর কিছু টিপস দিয়েছেন যশোরের গুড়ের রাজ্যখ্যাত খাজুরা গ্রামের কারিগর জুলহাস মিয়া ও মমতাজ খাতুন।
কেনার সময় একটু গুড় ভেঙে নিয়ে চেখে দেখুন। জিভে নোনতা স্বাদ পেলেই বুঝতে হবে গুড়ে আছে কোনো না কোনো গড়বড়। তবে মুখে দেয়ার পর নরম লাগলে এবং দ্রুত গলে গেলে ঝটপট কিনে ফেলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
গুড়ের প্রান্ত কঠিন হলে সেই গুড়ে চিনি যোগ করা হয়েছে- এটা মোটামুটি নিশ্চিত। আর একটু তেতো স্বাদের হলে বুঝতে হবে গুড়টি বহু ক্ষণ ধরে জ্বাল দেয়া হয়েছে। স্বাদের দিক থেকে এমন গুড় খুব একটা সুখকর হবে না।
সাধারণত গুড়ের রং বাদামি হয়। হলদেটে রঙের গুড় দেখলেই বুঝতে হবে অতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়েছে। খাঁটি খেজুরের গুড় কখনও খুব বেশি উজ্জ্বল ও ঝকঝকে হয় না।
খাজুরার কারিগরেরা নিউজবাংলাকে জানান, অনেক সময় খেজুরের রস জ্বালানোর সময় আখের গুড়ের ‘মুচি’ (পাটালির মতো শক্ত) ও পুরনো গুড় (উলা গুড়) এর সঙ্গে মিশিয়ে ঘন করা হয়। এরপর তাতে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করা হয়। পাটালির গন্ধ আনতে বিশেষ ধরনের রাসায়নিকও ব্যবহার করেন অসাধু কারিগরেরা।
৫০ টাকা কেজি দরের চিনি আর ৭০ টাকা দরের আখের গুড়ের মুচি দিয়ে তৈরি এসব নকল খেজুর পাটালি বিক্রি হয় দুই শ’ থেকে আড়াই শ’ টাকা দরে।
যশোরের বড়বাজারে নিরঞ্জন সাহা দীর্ঘদিন ধরে গুড় বিক্রি করেন। তার দাবি, খেজুর গুড়ের ক্ষেত্রে যশোরের গুড়ই সেরা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কম দামে নাটোরের গুড় বিক্রি হয়, তবে যশোরের গুড়ের ভালো মানেরটা ২৮০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না।’
খাঁটি গুড় চেনার উপায় বাতলে তিনি বলেন, ‘এটার হালকা সুবাস, মিষ্টি স্বাদও হালকা, দেখতে লাইট কালার। এর বাইরে যে কয় ধরনের গুড় বিক্রি হয় সবটাই চিনি মেশানো।’
যশোর থেকে সরাসরি গুড় কিনে অনলাইনে বিক্রি করছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন শপ সেভ অ্যান্ড শপ বিডি’র কর্ণধার শাহনাজ পারভীন অর্থি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘খাঁটি খেজুর গুড় চেনার উপায় হচ্ছে এটা হালকা মিষ্টি লাগে, আর চিনি মেশানো গুড়টা কড়া মিষ্টি। খাঁটি গুড় দেখতে লাইট কালারের হয়, কিন্তু চিনি মিশ্রিত গুড় ডিপ কালারের হয়।’
যশোরের বিস্ময় নলেন গুড়
যশোরের খাজুরা এলাকাতেই পাওয়া যায় দেশসেরা নলেন গুড়। এই গুড় আসে এক বিশেষ ধরনের খেজুর রস থেকে, যা এলাকায় নলেন রস বলে পরিচিত।
বিশেষ প্রক্রিয়ায় গাছ কেটে সংগ্রহ করা হয় নলেন রস। এজন্য আশ্বিনের শেষের দিকে গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে থাকেন। গাছের বাকল কেটে চেছে ‘গাছ তোলা’ হয়। তারপর নির্দিষ্ট জায়গা সাফ-সুতরো করে সুদক্ষ স্বশিক্ষিত গাছি রস সংগ্রহের প্রক্রিয়া শেষ করেন।
সংগ্রহ করা এই রস মাটির চুলায় জ্বাল দেয়ার সময় বিশেষ ধরনের হাতা দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে হয়। যত সময় যায়, ততই নলেন গুড়ের গন্ধ বেরিয়ে আসে। গন্ধ যত বেশি গুড় ততটাই খাঁটি। তবে গুড়ের রং হালকা করার জন্যে অনেকে সোডিয়াম হাইড্রোজেন সালফাইট ব্যবহার করেন। এজন্য হালকা বা গাঢ় নয়- নলেন গুড় কেনা উচিত মাঝারি রং দেখে।
আর বলাই বাহুল্য, নলেন গুড়ের তৈরি সন্দেশ, ক্ষীর, পায়েসের স্বাদ জিবে লেগে থাকে বহু দিন।