দীর্ঘ দিনের অচলাবস্থা ও টানাপড়েন শেষে নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পের একটি দলকে প্রথম দফায় নেয়া হয় সেখানে। এরপর মঙ্গলবার যায় দ্বিতীয় দল। এভাবে পর্যায়ক্রমে ভাসানচরে যাবে এক লাখ রোহিঙ্গা।
প্রথম ধাপে ভাসানচরে পাঠানো দলে ছিলেন এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গা। আর দ্বিতীয় দলে সদস্য এক হাজার ৮০৪। এদের সবাই স্বেচ্ছায় কক্সবাজার ছেড়েছেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে থেকে ছিল আরও প্রায় চার লাখ। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে তিন বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। দুই বার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও থমকে যায় উদ্যোগ।
বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার চাপ বছরের পর বছর বইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সেইসঙ্গে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। স্থানীয়দের জীবন-জীবিকায় পড়েছে হুমকিতে। রোহিঙ্গারা প্রায়ই সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ছে স্থানীয়দের সঙ্গে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং জঙ্গিবাদ ও মাদকের উত্থান আশংকার বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে পাহাড় ধসের শংকা বাড়ছে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে। এমন অবস্থায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
নিজস্ব অর্থায়নে নৌবাহিনীর মাধ্যমে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নোয়াখালীর ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সরকার। তবে রোহিঙ্গাদের সেখানে নেয়ার উদ্যোগে তৈরি হয় নানা জটিলতা। জাতিসংঘসহ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানা অজুহাত তুলে আপত্তি জানাতে শুরু করে।
এর মধ্যে সেপ্টেম্বরের শুরুতে উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্প থেকে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে ভাসানচর ঘুরিয়ে আনে সরকার। এছাড়া, করোনা মহামারির শুরুতেও সাগরে ভাসতে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গাকেও ভাসানচরে পাঠানো হয়। ২২টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) প্রতিনিধি দলও ভাসানচরের ব্যবস্থাপনায় সন্তোষ প্রকাশ করে। ঘুরে এসে দলের সদস্যরা জানান, উন্নতমানের একটি আবাসিক এলাকায় যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তার সবই রয়েছে ভাসানচরে।
এসব কারণেই জটিলতা কাটিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা হস্তান্তর প্রক্রিয়া গতি পায়।
রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আধুনিক বাসস্থান ছাড়াও বেসামরিক প্রশাসনের প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভবন, মসজিদ, স্কুল, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও হচ্ছে। পালন করা হচ্ছে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর।
সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পটি মূলত ক্লাস্টার হাউস, শেল্টার স্টেশন বা গুচ্ছগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মোট ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে ১৬টি করে কক্ষ রয়েছে। এগুলো মাটি থেকে চার ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগের ঘূর্ণিঝড় সহনীয় একটি শেল্টার স্টেশন রয়েছে। দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরির কাজও শেষ পর্যায়ে।