বছরের মাঝামাঝি একটি হত্যা কাঁপিয়ে দেয় সারা দেশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এনকাউন্টার দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এক মেজরের মৃত্যু পুরো পুলিশ বাহিনীর ভিত নাড়িয়ে দেয়।
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন মাধ্যমে। এ ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের ঘটনাও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে কমে গেছে বলে অনেকে মনে করেন।
ঘটনার সূত্রপাত ৩১ জুলাই। স্থান কক্সবাজার।
ওই দিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।আরও পড়ুন: প্রদীপের মাদক কারবার জেনে ফেলায় সিনহা হত্যা: র্যাব
শুরুতে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সিনহা ওইখানে থাকা একটি তল্লাশি চৌকিতে বাধা দেন। আর তিনি পিস্তল বের করলে চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে।
তবে পুলিশের বক্তব্য নিয়ে সে সময় প্রশ্ন ওঠে। সিনহা হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি ওঠে, যা নিশ্চিত করার আশ্বাস দেয়া হয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
৫ আগস্ট কক্সবাজারের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয় জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
মেজর সিনহা হত্যা মামলার প্রধান আসামি টেকনাফ থানার সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ। ফাইল ছবি
মামলাটির তদন্তভার পায় র্যব। ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় ৬ আগস্ট সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে র্যাব স্থানীয় তিন জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ১৪ জন হলেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, ওসি প্রদীপ, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। আসামি কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক রয়েছেন।
গত ১৩ ডিসেম্বর মামলার চার মাস আট দিনের মাথায় কক্সবাজারে বিচারিক আদালতে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র জমা দেয় র্যাব। গ্রেপ্তার ১৪ জনের বাইরে পলাতক সাগর দেবকেও অভিযুক্ত করা হয়। মামলা তদন্ত করেন র্যাব-১৫-এর সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম।
সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর র্যাবের দেয়া অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছে আদালত। একই সঙ্গে মামলার পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
সিনহা হত্যা মামলার আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা নিউজবাংলাকে বলেছেন, ‘আমরা এখন বিচারকাজ শুরুর অপেক্ষায় আছি। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি।’
কক্সবাজার আদালতে মেজর সিনহা হত্যা মামলার আসামি পুলিশ সদস্যরা
মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘র্যাবের চার্জশিটে আমরা সন্তুষ্ট। তারা নিরপেক্ষভাবে মামলাটি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। লিয়াকত ও প্রদীপ সরাসরি আমার ভাইকে হত্যার সঙ্গে জড়িত। যে বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে ও চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করছি। জড়িত অন্যদের অপরাধও তদন্তে উঠে এসেছে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমরা আস্থা রাখতে চাই। আশা করি, ন্যায়বিচার পাব।’
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের পরিকল্পনায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে হত্যা করা হয়। আর তা বাস্তবায়ন করেন পরিদর্শক লিয়াকত।
মেজর সিনহা ভ্রমণ বিষয়ে ভিডিও তৈরির জন্য কক্সবাজার গেলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে মাদক পাচার ও এর সঙ্গে জড়িতদের তথ্য পান। ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মাদক পাচার ও স্থানীয়দের দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের তথ্য পান সিনহা। তখন তিনি এসব বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। এসব বিষয় নিয়ে ৭ জুলাই ওসি প্রদীপের সাক্ষাৎকার নিতে যান সিনহা। তখনই প্রদীপ তাকে হুমকি দেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সংবাদ সম্মেলন করে জানান, গত ৭ জুলাই টেকনাফ থানায় ওসি প্রদীপের সাক্ষাতকার নিতে যান মেজর সিনহা। তখন তাকে কক্সবাজার ছাড়তে হুমকি দেয়া হয়। হুমকি উপেক্ষা করে সিনহা তার কাজ চালিয়ে গেলে, তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘প্রদীপ ভেবেছিল, হুমকি দিলে সিনহা কক্সবাজার ত্যাগ করবে। কিন্তু কক্সবাজার ত্যাগ না করায় তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে এমনটিই পেয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘এ মামলার তদন্তের মূল বিষয় হচ্ছে এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।… প্রদীপের স্বেচ্ছাচারিতা ও ইয়াবা বাণিজ্যের বিষয়টি সিনহা জেনে যাওয়ায় এই ঘটনা।’
সিনহার সঙ্গে কক্সবাজারে ভিডিও ধারণে কক্সবাজারে যাওয়া শফিকুল ইসলাম সিফাত ও শীপ্রা দেবনাথ। ফাইল ছবি
র্যাবের তদন্তে ওসি প্রদীপের অপকর্মের তথ্য উঠে এসেছে। তা প্রতিবেদনে যুক্ত করা হয়েছে। মাদক বাণিজ্যে প্রদীপের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে এবং প্রদীপ ছিলেন মাদক কারবারিদের প্রশ্রয়দাতা।
প্রশ্ন ওঠে, সিনহা হত্যার মধ্য দিয়ে বিচারবিহর্ভূত হত্যা থামবে কি?
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ২২০ জন। তবে এর প্রায় অধিকাংশ হয়েছে জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে। সেই সংখ্যাটা ২১৩। বাকি সাত জন মারা গেছেন সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে।
সংখ্যাগত দিক থেকে কমে যাওয়ায় সন্তুষ্ট হওয়ার মতো সময় আসেনি বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না। কারণ এখন ভিন্ন অবস্থা বিরাজ করছে। সিনহা হত্যার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতেও মৃত্যুর ঘটনা আছে। ফলে বন্ধ হয়নি, বিচারবিহর্ভূত হত্যা কিছুটা কম হয়েছে। আমাদের আরও সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নূর খান বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হলে আগের ঘটনাগুলোর বিচার শুরু করতে হবে। পৃথক কমিশন ঘটনের মাধ্যমে এসব হত্যার বিচার করতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সাহস পাবে না।’