১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের মানুষের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। চালায় গণহত্যা। নিরীহ, নির্দোষ মানুষগুলোকে ধরে ধরে গুলি করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এসব মানুষদের গণকবর দেয়া হয়েছে।
রাজবাড়ীর বেশ কয়েকটি স্থানে ঘটেছিল এমন নারকীয় ঘটনা। রয়েছে অনেক গণকবর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর পরেও সেসব গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলার মুক্তিযোদ্ধারা।
রাজবাড়ী শহরের লোকোশেড, বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শালবরাট, রামদিয়া, নারায়ণপুর, ঠাকুরনওপাড়া, পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি তিন চারা রেলব্রীজ, মাছপাড়া রেল স্টেশন এলাকা এবং কালুখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন মালিয়াট এলাকায় মিলেছে গণকবরের সন্ধান।
এর মধ্যে লোকোশেডে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। বাকিগুলো এখনও অরক্ষিত ও অযত্নে পড়ে আছে।
জেলার সবচেয়ে বড় গণকবরটি বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শালবরাটে। যেখানে চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
রাজবাড়ী বালিয়াকান্দির শালবরাট। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা স্থানটি পরিদর্শন করেন। ছবি: নিউজবাংলা
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমান গণহত্যার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমি যশোরে যুদ্ধ করছিলাম। তখন শুনতে পাই বালিয়াকান্দিতে সেনা ঢুকবে। আমি যশোর থেকে চলে আসি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একটি ট্রেন আসে। ট্রেনটি নাওপাড়া, শালবরাট, নারায়ণপুর এলাকায় থামে। এসব জায়গায় সেনারা নেমেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।
‘ব্রাশফায়ার করে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। ওই সময় কেউ পালিয়ে যায়। কেউ পালাতে চেয়েও পারেনি। সেদিন এলাকার নিতাই চন্দ্র সরকার, সুরেন্দ্র নাথ সরকার, চন্ডী সাহা, চুনী সাহা, প্রমিলা রানী, কালীদাসী, চন্ডিদাসীসহ অনেক মানুষকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এই তিনটি জায়গায় কম করে হলেও এক হাজার মানুষকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।’
পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের তিন চারা রেল ব্রীজের কাছে রয়েছে একটি বড় গণকবর। যেখানে মানুষকে ট্রেনে করে এনে নামিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল।
নির্মম এসব হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা মো. উসমান গণি জানান, সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের ৫ তারিখ। কৃষকরা মাঠে বীজ বপণ করছিলেন। বেলা ১১টা বা ১২টার দিকে একটি ট্রেন এসে থামে তিনচারা রেল ব্রিজের কাছে। পাকিস্তানি সেনারা এক জনকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ব্রিজের কাছে এনে বলে ‘মাথা নিচু কর’। না শুনলে তাকে ওভাবেই গলা কেটে ব্রিজের নিচে ফেলে দেয়। এভাবে ২১ জনকে ট্রেন থেকে নামিয়ে হত্যা করে সবার মরদেহ ব্রিজের নিচে ফেলে দেয়া হয়। এসব দেখে মাঠে কাজ করা কৃষকরা দৌড়ে পালিয়ে যান। এক সপ্তাহ পরে ডোম মেথররা দুটি গর্ত করে লাশগুলো চাপা দেয়।
পাংশার তিনচারা রেল ব্রিজ। এখানে ২১ জনকে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
রাজবাড়ীর কালুখালী রেল স্টেশন সংলগ্ন মালিয়াটে মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লতা কুলি নামে একজন বিহারি ছিল। এই রেলপথ দিয়ে ট্রেন যাতায়াতের সময় সে ট্রেনে উঠে বাঙালি যুবকদের এনে নির্বিচারে হত্যা করে ওই স্থানে ফেলে রাখত। এভাবে সে ১৯ জনকে হত্যা করে লাশ চাপা দিয়েছে। তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারত না।
গণকবরের স্থানটিতে ১০ ফুট লম্বা ও দুই ফুট উচ্চতার একটি দেয়াল করা হয়েছে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। আশপাশ আবর্জনায় ভরা। জানা গেছে, জায়গাটি বেদখল হয়ে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে গণকবরের জায়গাটি উদ্ধার করে এই দেয়ালটি করা হয়। কিন্তু এখনও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে।
যুদ্ধকালীন কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাসেম বলেন, ‘১৯৭১ সালে রাজাকার, বিহারি, পাকিস্তানি বাহিনী, মিলিশিয়ারা মিলে গ্রামে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তারা গুলি করে, কুপিয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
রাজবাড়ী কালুখালীর মারিয়াট বধ্যভূমি। ছবি: নিউজবাংলা
‘রাজবাড়ীর গণকবরগুলো অযত্নে পড়ে আছে। আজ পর্যন্তও কেউ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এসব গণকবর সংরক্ষণ করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো বিষয় সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। রাজবাড়ীর গণকবরগুলো চিহ্নিত করতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলব। পরে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’