২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ফ্রান্সপ্রবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রকাশ রায় ও সংগীতশিল্পী আরিফ রানার সঙ্গে হাজির হই প্যারিসের অভিজাত পাড়ার এক বাড়িতে। এই বাড়িতে থাকেন এক বাঙালি কবি ও গবেষক। তখনই তার বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি। নাম পৃথীন্দ্রনাথ মুখার্জী। ভারতীয় বংশদ্ভূত এই ফরাসির সঙ্গে বাংলাদেশেরও রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক।
বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় তার পূর্বপুরুষের ভিটে। ‘বাঘা যতীন’ নামে উপমহাদেশে পরিচিত বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নাতি তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্যে যে বিদেশি বন্ধুদের আমরা খেতাব দিয়েছি, তিনি তাদের একজন। অসুস্থতার কারণে তিনি ঢাকায় এসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেননি। সেবার তার হয়ে পদক গ্রহণ করেছিলেন ঢাকায় সে সময়ের ফরাসি রাষ্ট্রদূত।
প্যারিসের বাঙালি কমিউনিটির সবার প্রিয় ‘পৃথীনদা’ তিনি। জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হলেও তার পূর্বপুরুষের ভিটা বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়। ফরাসি দর্শন, সাহিত্য, ভারতীয় দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক হিসেবে তিনি পেয়েছেন ফরাসি সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা, পদক ও ফরাসি একাডেমি খেতাব। কবিতায় রয়েছে তার দারুণ দখল। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন অন্যতম রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একাধিক কাহিনিচিত্র।
সেদিনের আড্ডায় এ গুণী পণ্ডিত বলছিলেন, প্যারিসে বসবাসের শুরুতেই ফরাসি মূল স্রোতের গুণীজনদের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। যদিও শেষ বয়সে এসে ধরা দিয়েছেন ‘বাঙাল’ বা বাঙালিদের কাছে।
সাত বছর বয়সেই টাইফয়েডের কারণে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। কেবল প্রবল মানসিক শক্তির কারণে হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে উঠে গেছেন সাফল্যের শিখরে। আড্ডায়ও দারুণ ‘জোশ’ তার। বলে চলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার জড়িয়ে পড়ার গল্প।
তিনি বলেন, তার নানাবাড়ি কুষ্টিয়া আর নিজেদের আদি বাড়ি সেকালের যশোরে, যা বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার অংশ। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঘা যতীনের সেই ভিটায় জাদুঘর ও ক্যান্টনমেন্ট করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পর সে সম্ভাবনা গেছে তিমিরে মিলিয়ে। বাকি সব সম্পত্তিসহ বাঘা যতীনের ভিটেবাড়ি হয়েছে বেদখল।
পৃথীন্দ্রনাথ বলেন, ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন তার রক্তেও যুদ্ধে যাওয়ার নেশা ধরেছিল। তিনি তখন প্যারিস সরকারের ফেলো হিসেবে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন। একই সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, ফরাসি রেডিও এবং টেলিভিশনের প্রযোজক হিসেবে। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, সবই মিছে। বারবার মনে হচ্ছিল বাপ-ঠাকুরদার ভিটে রক্ষায় অংশ নেওয়া উচিত এই যুদ্ধে।
তিনি বলেন, ‘করণীয় ঠিক করতে না পেরে একদিন গেলাম প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাসে। ভারতের রাষ্ট্রদূত আমাকে জানালেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি প্যারিসে থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার পরামর্শ দিলেন। কষ্ট হলেও আমি সেই পরামর্শ মেনে নিলাম। কারণ মন পড়েছিল, বর্ষাস্নাত তাল-হিজলের দেশের সবুজ গ্রামে, যেখান দিয়ে হলিউডি সিনেমার দৃশ্যের মতো বৃষ্টিতেও ধোঁয়া ওড়ে।’
পৃথীন বলেন, এরপরই শামসুর রাহমান, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলামসহ বাংলা ভাষার কবিদের কবিতা দ্রুত ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেন তিনি। রেডিওতে সেই কবিতাগুলো জনপ্রিয় আবৃত্তিকারদের দিয়ে আবৃত্তি করাতেন। টেলিভিশনেও আবৃত্তি করাতেন ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের দিয়ে। রেকর্ডগুলো বিক্রি করে তহবিল জোগাড় হতো মুজিবনগর সরকারের জন্য।
কেবল তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিলো মদঁ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লেখেন।
ফরাসি ও ইংরেজি পত্রিকায় প্রতিদিনই কলাম লিখতেন পৃথীন্দ্রনাথ। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ও পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত ছাপছিলেন যুদ্ধের ভয়াবহতা আর নিষ্ঠুরতার কথা। এভাবেই ফরাসি দেশে বাংলাদেশের পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি।
সরাসরি ময়দানেও যুদ্ধ করতে পারতেন তিনি। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে সে সময় বহির্বিশ্বে মতামত তৈরি করাও ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তিনি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে ১৯৭৩ সালে পৃথীন্দ্রনাথ ঢাকায় এসেছিলেন। সেই স্মৃতি হাতড়ে আনন্দে চিকচিক করে ওঠে তার চোখ। বঙ্গবন্ধুর নাম বলে করজোড় কপালে ছুঁয়ে বলে ওঠলেন, ‘যে আগুন আমাদের এত দূর এগিয়ে এনেছে, তাকে প্রণাম। আমার দাদুর শিষ্যরা কলকাতায় তার গুরু ছিলেন।’
তার উদ্যোগে জ্যাঁ পল সার্ত্র, আন্দ্রে মালরোর মতো মহান ফরাসি দার্শনিকদের তিনি বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মালরো বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধের জন্য একটি আর্ন্তজাতিক ব্রিগেডও গঠন করেছিলেন। তিনি নিক্সনকেও চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত সেই কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পদক দিয়েছে। ফরাসি সরকার দিয়েছে ‘নাইট’ উপাধি। তবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার একটাই, আর সেটা বাংলাদেশ সরকারের দেয়া মৈত্রী পুরস্কার।
একাত্তরে আটক হয়েছিলেন পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যয়। সে আরেক গল্প।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর জঁ ক্যা নামে এক জেদি লড়াকু ফরাসি তরুণ এক দুঃসাহসিক কাণ্ড করেছিলেন। প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে একটি পাকিস্তানের বিমান জিম্মি করেছিলেন ২৮ বছর বয়সী এই তরুণ। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে ফরাসি সরকারকে বাধ্য করা।
১৭ জন যাত্রী ও ছয়জন ক্রু নিয়ে বিমানটি লন্ডন থেকে প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে করাচি যাচ্ছিল। এর মধ্যে পাঁচ যাত্রী প্যারিস থেকে ওঠার কথা। ওই পাঁচ জনের সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যূহ ভেদ করে উড়োজাহাজে উঠে বসেন জঁ ক্যা।
বেলা তখন ১১টা ৫০ মিনিট। পাইলট আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি হিসেবে বিমানটি চালু করতেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে জঁ ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। কেউ তার নির্দেশ অমান্য করলে সঙ্গে থাকা বোমা দিয়ে পুরো বিমানবন্দর উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন তিনি। ওয়্যারলেস কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে জঁ নির্দেশ দেন বিমানটিতে যাতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিত্সা সামগ্রী তুলে তা যুদ্ধাহত ও বাংলাদেশি শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও তার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নাড়াতে পারেনি।
প্যারিসের সব পুলিশ যেন সেই দিন অরলি বিমানবন্দরে এসে হাজির হয়েছিল।
জঁ ক্যাকে ছাড়াতে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হন পৃথীন্দ্রনাথ। আটক অবস্থাতেই জানতে পারেন দীর্ঘ আট ঘণ্টার অপারেশন শেষে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের (পিআইএ) বিমানটিকে জঁ-এর কাছ থেকে মুক্ত করেছে পুলিশ। জঁকে গ্রেফতার করে অরলি পুলিশ ফাঁড়িতে নেয়া হয়।
‘বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে অস্ত্র হাতে নিতে আমি প্রস্তুত’ – এমন ঘোষণা দিয়ে তখন ফ্রান্সসহ ইউরোপজুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী লেখক আন্দ্রে মালরো। জঁ গ্রেফতার হয়েছেন খবর পেয়ে তিনিও ছুটে গিয়েছিলেন অরলি পুলিশ স্টেশনে। ফ্রান্স সরকারের সঙ্গে কথা বলে গলের মন্ত্রিসভার মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী মালরো পৃথীন্দ্রনাথকে থানা থেকে মুক্ত ককরেন। এরপর মালরো নামেন জঁ-এর মুক্তির লড়াইয়ে।