স্বাধীনতার ৪৯ বছর পার হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বসতভিটার। সংস্কারের অভাবে বীরশ্রেষ্ঠর নিজ ঘর এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এমনকি নদী ভাঙনের কারণে হুমকিতে তার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও।
স্থানীয়রা বলছেন, নদী ভাঙন রোধ এবং শিগগিরই সরকারি কোনো পদক্ষেপ না নিলে জাতির এই বীর সন্তানের স্মৃতি বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাশাপাশি মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাড়ির সামনে তার নামে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মাণ হলেও সেগুলো অবহেলায় কমে গেছে দর্শনার্থী আসার সংখ্যা। ভবনটির দুরবস্থায় নেই কোনো লাইব্রেরিয়ান ও কেয়ারটেকার।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার ও মাতা মোসা. সানিয়া খাতুন।
১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৬৬ সালে আইএসসি পাসের পর বিমান বাহিনীতে চাকরির চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের সমস্যা থাকায় ব্যর্থ হন।
১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ানে কর্মরত ছিলেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
পাকিস্তানের দুর্গম সেই এলাকা থেকে যুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ৩ জুলাই পাকিস্তানে আটকে পড়া আরও তিন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে যান এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭ নম্বর সেক্টরে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যোগ দেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের অধীনে যুদ্ধ করেন তিনি।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন তারা। কথা ছিল ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি গোলাবর্ষণ করবে। কিন্তু সেটি হয়নি। এমনকি পরের দুদিন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই ১৩ ডিসেম্বর রাতে হানাদারদের আক্রমণ করবেন।
১৪ ডিসেম্বর বড়গড়িয়া মহানন্দা নদীর পারে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ চলে। হানাদারদের চারটির মধ্যে শেষ বাঙ্কার ধ্বংসের জন্য মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর একা সেখানে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষের ছোড়া গুলি তার কপালে লাগে। সেখানেই শহিদ হন তিনি।
পরে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ আঙিনায় সমাহিত করা হয়েছে। বরিশালের নিজ গ্রাম রহিমগঞ্জ তার দাদার নামে হওয়ায় পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছা অনুসারে তার ইউনিয়নের নাম ‘আগরপুর’ পরিবর্তন করে ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর’ করে সরকার।
জানা গেছে, সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের কারিগরি নির্দেশনায় বরিশাল জেলা পরিষদ ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দান করা ৪০ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। ২০০৮ সালের ২১ মে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করা হয়।
জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের যে জাদুঘর, তার স্মৃতিস্থান এভাবে অবহেলিত থাকবে সেটা আমরা কখনও আশা করিনি। এই এলাকার সংসদ সদস্যের উচিত ছিল এলাকার রাস্তা, স্মৃতিজাদুঘর রক্ষা, নদীভাঙন রোধ করা। ইতিহাসের সব বইতে বীরশ্রেষ্ঠদের নাম রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের স্মৃতি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের স্মৃতি জাদুঘর হওয়া উচিত ছিল দর্শনীয় একটি স্থান। যেখানে শিক্ষা সফর থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীরা আসবে। তারা বীরশ্রেষ্ঠর জীবনী জানবে। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। বাড়ির সামনে আলো নেই, রাতে ভূতুড়ে অবস্থা হয়ে যায় বীরশ্রেষ্ঠর বাড়ি ও জাদুঘর।’
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই হারুন অর রশীদ বলেন, ‘২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জাদুঘরটি নির্মাণ হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার থেকেও এর কোনো উন্নতি হয়নি। জাদুঘর ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থা। তা ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় মানুষ এখানে আসতেও পারছেন না।
‘ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হলে মানুষের এখানে আসতে অসুবিধা হতো না। এ ছাড়া নদী ভাঙনের কারণে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাড়ি, জাদুঘর, তার নামে কলেজ ও স্কুল হুমকির মুখে।’
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ভাই মঞ্জুর রহমান বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠর নামে এই জাদুঘরে দূর থেকে মানুষ এসে দুঃখ প্রকাশ করেন এর জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে। এখানে জাদুঘরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সহকারী লাইব্রেরিয়ান থাকার কথা থাকলেও নেই। জাদুঘরে যাতে মানুষ সহজে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা ও নদী ভাঙন থেকে বীরশ্রেষ্ঠর স্মৃতি রক্ষার দাবি জানাচ্ছি।’
বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের বাড়ি সংরক্ষণে আমরা ঢাকায় প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তা ছাড়া কীভাবে তার বাড়ি ও নদী ভাঙন থেকে তার স্মৃতি রক্ষা করা যায় সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’