পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোর পুরোটাই দৃশ্যমান। দ্বিতল সেতুর ওপরের অংশে সড়ক আর নিচে রেল লাইন স্থাপন করে এক বছরের মধ্যে সেতু চালু করায় আশাবাদী সরকার।
তবে সেতুটি আরও আগেই হয়ে যেতে পারত। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তির দিন জানানো হয়, ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করে সেতু খুলে দিতে চায় সরকার। তবে ২০২০ সালের শেষে এসে বসল সব স্প্যান। আরও এক বছর লাগবে কাজ শেষ হতে।
তবে এই সেতু নির্মাণের উদ্যোগের পর থেকে নানা কারণে বিঘ্ন ঘটেছে, পিছিয়েছে কয়েক বছর। এর মধ্যে প্রাকৃতিক বাধার চেয়ে বেশি কারণে পিছিয়েছে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে, যেটি তুলেছিল দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক।
দুর্নীতি চেষ্টার যে অভিযোগ ছিল, সেটি কেবল সরকার নয়, দেশের জন্যও ছিল মানহানিকর। আর সে অভিযোগ থেকে বাংলাদেশ দায়মুক্তি পায় দেশ নয়, বিদেশের একটি আদালতের রায়ে।
অভিযোগ ছিল গুরুতর। সেতুর পরামর্শকের কাজ পেতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ঘুষ দেয়ার পরিকল্পনা জানতে পারার কথা বলে বিশ্বব্যাংক। এ নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গণে তোলপাড়। সরকারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করতে তাকে বিরোধীরা।
সরকার শুরু থেকেই সব অভিযোগকে বায়বীয় বলে আসলেও আক্রমণ কমেনি। পরে দুর্নীতি চেষ্টার যে অভিযোগ তা নাচক হয় মূলত কানাডার একটি আদালতের রায়ে। কিন্তু বহুজনের কাছেই সেই বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
পদ্মা সেতু নির্মাণে নদীর বুকে ফেরিতে ঋণ চুক্তিতে সই করছেন বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। ছবি: ফোকাস বাংলা
সেতু নির্মাণে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। তাদের দেয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। এরপর ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি সই হয়। এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেবে বলে ঠিক হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করতে থাকে, সেতুর পরামর্শক নিয়োগের কাজ পেতে কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করে। এ কারণে ঋণচুক্তি স্থগিত করে।
বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনতে ছাড় দিয়েও চেষ্টা করে সরকার। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করে সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করে। তখন বিশ্বব্যাংক চাপ দিতে থাকে সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করার। কিন্তু সেটি করেনি দুদক।
সে সময়ে এসএনসি লাভালিনের এক কর্মকর্তার ডায়েরিতে কাকে কাকে ঘুষ দিতে হবে, তার তালিকা করা ছিল বলে খবর ছড়ায়। তবে এর সত্যতা কখনও পাওয়া যায়নি। বারবার অনুরোধ করা হলেও দুদককে সে ডায়েরি দেয়া হয়নি।
শুরুতেই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক। তাতে মন্ত্রীত্ব হারাতে হয় সে সময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনকে।
২০১২ সালে কানাডার আদালতে এ ব্যাপারে মামলা করা হয়। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজে দুর্নীতির ঘটনায় এসএনসিকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এই মামলাটি শাপেবর হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার আদেশ কানাডা থেকে আসার পর আর কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগই পায়নি।
রায়টি দেয়া হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। তবে গণমাধ্যমে রায় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা ছিল এক মাস। আর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে জানাজানি হয়।
বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মাসেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে নিজেরা তদন্ত শুরু করে। অভিযোগ সম্পর্কে নিজেদের তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশকে (আরসিএমপি) অনুরোধ জানায়। ওই অনুরোধে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডায় এসএনসি লাভালিনের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে রমেশ শাহ ও সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে আদালত জানায়, বিশ্ব ব্যাংক চারজন বেনামী তথ্যদাতার বরাতে কানাডার আদালত আরসিএমপির কাছে অভিযোগ পাঠায়।
রায়ে অন্টারিও সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ইয়ান নরডেইমার বলেন, বিশ্বব্যাংক যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে সেগুলো ‘অনুমানভিত্তিক, গালগল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়’।
বিচারক বলেন, ‘ওই গুজব বা অনুমানকে সমর্থন করে এমন ঘটনা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি বা তার তদন্ত হয়নি। যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে তা শোনা কথা’।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ার শুরু থেকেই এ নিয়ে তুমুল আলোচনা তৈরি হয় বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে।
পদ্মায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরিতে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার।
এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় হয়। অভিযোগটি ছিল পরামর্শকের কাজ পেতে কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএমসি লাভালিন ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে। ইঙ্গিত করা হয় সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রতি।
আবুল হোসেন ও সরকার এই অভিযোগকে মিথ্যা বলেন। তবে বিশ্বব্যাংকের চাপে এই ঘটনায় তদন্ত হয় আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। গ্রেফতার হন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের চাপে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এতে প্রধান আসামি করা হয় সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে।
বাকি ছয় আসামি হলেন- সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদী শাসন) কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালটেন্ট লিমিটেডের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশে কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোস্তফা, এসএনসি-লাভালিনের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইল, এই সংস্থার আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহ ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস।
২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পদ্মা সেতু দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলা থেকে সাত আসামিসহ সবাইকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক।
কানাডার আদালতে সব মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যাওয়ার পর এই দুর্নীতির অভিযোগ আর তোলেনি কেউ। আর মোশাররফকে রাষ্ট্রদূত করে পুরষ্কৃত করে সরকার।
আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও নিষ্পত্তি করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রায় সাড়ে চার বছর পর ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সেই অভিযোগ নিষ্পত্তির চিঠি যায় পদত্যাগী যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে।
এতে বলা হয়, ‘সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণের নিমিত্ত প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগটি অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য ও রেকর্ডপত্রের আলোকে প্রমাণিত হয়নি বিধায় তা দুদক কর্তৃক অনুসন্ধান পরিসমাপ্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।’
শুরুতে ২৯০ কোটি ডলারের নেয়া এই প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ দেয়ার কথা ছিল ১২০ কোটি ডলার। এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেয়ার জন্য চুক্তি করে সরকারের সঙ্গে।
কিন্তু বায়বীয় অভিযোগে ২০১২ সালের জুনে এই প্রকল্প থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। আর চুক্তি অনুযায়ী সবচেয়ে বড় দাতা সংস্থাটি সরে যাওয়ায় অন্যরাও ঋণ চৃক্তি বাতিল করে।
বিশ্বব্যাংকের টালবাহানায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। শুরুতে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ এবং বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে আসছিল, এই চাপ নিতে পারবে না বাংলাদেশের অর্থনীতি। তবে পরে সেটি তথ্য প্রমাণ হয়নি।
এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। ২০১৪ সালের শুরুতে আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব থেকে সরেও যান। এমনকি তাকে আর মনোনয়নও দেয়নি আওয়ামী লীগ। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ‘সত্যিকারের দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দিয়ে এক ধরনের শান্ত্বনা দিয়েছিলেন।
অর্থায়ন নিয়ে জটিলতা, বিশ্বব্যাংকের গালগপ্পের অভিযোগ কাটিয়ে সেতু এগিয়ে চলার মধ্যে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ভাঙন, নদীর তলদেশে মাটির গঠনগত জটিলতার কারণে ২২টি পিলার নির্মাণে জটিলতা ছাড়াও আরও গুজব ছড়িয়েও সেতুর কাজে বাধা দেয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে পদ্মা সেতু তৈরিতে মাথা লাগবে এমন গুজব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। গুজবের বিস্তার এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যার ফলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় ৬৭ জন মানুষকে।
পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ছড়িয়ে পড়া গুজবের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকতে বলা হয়।
শুরুতে পরিকল্পনা ছিল পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার। পরে তা নির্ধারণ করা হয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এজন্য সেতুর নকশায় পরিবর্তন আনতে হয়। নানা জটিলতা পেরিয়ে ২০১৫ সালে শুরু হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ।
শুরুতে পরিকল্পনা ছিল একতলা সড়ক সেতু হবে। পরে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে ঠিক হয়, দ্বিতল সেতু হবে। আর সেটি নির্মিত হবে স্টিল দিয়ে।
২০১৪ সালে পদ্মায় মূল সেতু তৈরির দায়িত্ব পায় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি।
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল সেতুর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তখন ২০১৮ সালের মধ্যে সেতুর কাজ উদ্বোধনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। পরে নানা জটিলতায় তা পিছিয়ে গেল আরও কয়েক বছর।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আগামী বছরের শেষে এই সেতু উদ্বোধনের বিষয়ে আশাবাদী।