শারীরিক প্রতিবন্ধী আশরাফুল, বিশেষ স্কুল থেকে এইচএসসি পাস করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আখতার ফার্নিচারে চাকরি করতেন। করোনাকালে সেই চাকরিটি হারিয়েছেন তিনি।
বৃদ্ধ বাবা চাকরি হারিয়ে বেকার, তার আয়েই চলত সংসার। নিজের দুঃসহ জীবনের কথা তুলে ধরতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না আশরাফুল।
কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার দেখার কেউ নেই। চাকরি করার সময় বিশেষ গাড়িও ছিল সেটিও পড়ে থাকার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। কীভাবে আমাদের সংসার চলবে এটা আল্লাহ ভালো জানে।’
কাপড় সেলাই ও পুঁথির মালা তৈরি করে চলত বাক প্রতিবন্ধী তানিয়ার সংসার। তবে করোনার কারণে এখন কেউ অর্ডার নিয়ে আসে না। এখন তিন বেলা খাওয়ার টাকা জোগাড় করাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইশারা ভাষায় নিজের ভাব প্রকাশর পর সেটি অনুবাদ করেন আরেকজন। ইশারা ভাষায় তানিয়া বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট আছি, সবাই আমাকে একটু সহায্য করুন।’
আরেক বাক প্রতিবন্ধী বিপাশার মা বলেন, গৃহবন্দী থাকার কারণে শিশুদের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আগে নিয়মিত স্কুলে যেত, অনেক কিছু শিখত, সময়ও ভালো কাটত। এখন তারা অনুভব করছে তাদের বন্ধু হারিয়েছে।’
‘বাড়িতে তারা কী করবে। অভিভাবক হিসেবে এই প্রশ্ন আমারও’, বলেন বিপাশার মা।
তিনি বলেন, ‘আমি সামর্থ্যবান হওয়ার কারণে রাজধানীর বড় হাসপাতালে মেয়েকে চিকিৎসা করাতে পাচ্ছি। যাদের সামর্থ্য নেই তারা কী করবেন? এমন অনেক বাবা মা রয়েছে যারা দিন আনে দিন খান। তাদের খাওয়া দাওয়াও ঠিকভাবে হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তাদের বিষয়গুলো সরকারের ভাবা উচিত।’
শারীরিক প্রতিবন্ধী আশরাফুল। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস।
পারিবারিক আয় ও খরচ বিষয়ে একটি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক কোটি পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৮ জন; যার মধ্যে আনুমানিক ১৬ লাখ নিবন্ধিত হয়ে সরকারের ভাতা পেয়ে আসছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের করা একটি জরিপ বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমালা- এসডিজির ১১ নম্বর গোলে বলা হয়েছে, যে কোনো ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য বিশেষ পরিসেবা এবং নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা প্রয়োজন। তবে বাস্তব চিত্র অনেকটাই ভিন্ন।
করোনার মধ্যে প্রতিবন্ধীদের ধারণা ও সচেতনেতা বিষয়ে ব্রিজ ফাউন্ডেশন একটা জরিপ করে। তাতে দেখা গেছে, ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করোনাভাইরাস সম্পর্কে কিছুই জানে না; যার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
এদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাব বিনিময়ের। তারা তাদের দৈনন্দিন যোগাযোগ ইশারা ভাষার মাধ্যমে করে থাকে।
জরিপের তথ্য অনুসারে, ৪৮ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। লকডাউন পরিস্থিতির কারণে ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ নারী দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কর্মহীন দিন কাটাচ্ছেন শুধু প্রতিবন্ধিকতার কারণে।
কমিউনিকেশন, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিসোর্স মোবিলাইজেশন অ্যাডভাইজার স্বপনা রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার কারণে সবচেয়ে মানবেতার জীবন-যাপন করছে প্রতিবন্ধীরা। তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়িয়ে কীভাবে কর্মহীন প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় সেই বিষয়ের সরকারের ভাবা উচিত।’
সমাজসেবা অধিদফতর, প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচির সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনা মধ্যে আমাদের জরিপ কর্মকাণ্ড বন্ধ ছিল। এছাড়া অন্য কোনে বিশেষ কর্মসূচি নেয়া হয়নি। বিভিন্ন সময় ভাতা দেওয়া হয়। এটা হয়তো দেয়া হবে। অন্য কোনো কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়নি।