কিছুদিন আগেও যেখানে পুকুর ছিল। সেটি এখন বালুকাময় মাঠ। আইন অমান্য করে সিলেট সিটি করপোরেশন ভরাট করে দিয়েছে জলাশয়টি।
অথচ ভরাটের আগে চলতি বছরই এই পুকুরটি সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধণের নামে কোটি টাকা ব্যয় করে নগর কর্তৃপক্ষ। নগরের জলাশয় ভরাট ও সরকারি অর্থের অপচয়ের এই কাহিনি এমন এক সময়ে জানা গেল, যখন সিলেটে চলছে পানির জন্য হাহাকার।
গ্রিড লাইনে আগুনের পর বিদ্যুৎহীনতায় সিলেটে পানির তীব্র সংকট। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, সিলেট নগরের সব পুকুর, দিঘি ও ছড়া একে একে ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির জন্য এমন হাহাকার।
পরিবেশকর্মীদের বক্তব্যের সত্যতাও মিলেছে বুধ ও বৃহস্পতিবার নগরীতে ঘুরে। যেসব এলাকায় এখনও পুকুর ও দিঘি টিকে রয়েছে সেসব এলাকায় এই দুই দিন পানির সংকট ছিল অপেক্ষাকৃত কম। এসব এলাকার লোকদের ভিড় করে জলাশয় থেকে বিভিন্ন বাসনপত্র দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।
সিটি করপোরেশনের ভরাট করে দেয়া পুকুরটির অবস্থান সিলেট নগরের ১৯ নং ওয়ার্ডের রায়নগর এলাকায়। এটি রায়নগর সোনারপাড়া মসজিদের পুকুর নামে পরিচিত ছিল।
স্থানীয়রা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই সিটি করপোরেশন পুকুরটি ভরাট করে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর সিটি করপোরেশনের দাবি, সোনারপাড়া মসজিদ কমিটির আবেদনের প্রেক্ষিতেই এই পুকুর ভরাট করে দেয়া হয়েছে।
যদিও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনো ধরণের ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি।
যদি কোনো ব্যক্তি এই আইন লঙ্ঘন করেন তবে পাঁচ বছরের কারাদ- বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, সোনারপাড়ার এই পুকুরের চারপাশে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে গার্ডওয়াল ও এসএস রেলিং নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। নির্মাণ করা হয় ঘাট।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও ১৯ নং ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর দিনার খান হাসু এ কাজের উদ্বোধন করেন। ওই বছরই নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
চলতি বছরের শুরুতে এই পুকুর সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। গত ফেব্রুয়ারিতে এক্সেভেটর লাগিয়ে শুরু হয় খনন কাজ। এই সংস্কারে আরও প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এরপর গতমাসে পুকুরটি একেবারে ভরাট করে দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠেছে, ভরাট করতে চাইলে সরকারের কোটি টাকা ব্যয় করে সংস্কার কেন?
জলাধার ভরাট করা আইনত নিষিদ্ধ জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘মসজিদ কমিটি যদি পুকুরটি ভরাট করতে চায় তাহলে দুই বছর আগে যখন প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা হলো তখন কেনো তারা এ কথা জানাল না। সরকারি অর্থের অপচয়ের পর কেন ভরাটের আবদার?’
তিনি বলেন, ‘নগরে পুকুর-দিঘি থাকার প্রয়োজনীয়তা আমরা গত দুদিন ধরে টের পাচ্ছি। ভূগর্ভস্থ পানির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা যে কতবড় বোকামি তা গত মঙ্গলবারের গ্রিড লাইনে আগুনের পর থেকে নগরবাসী বুঝতে পারছে।’
বৃহস্পতিবার সোনারপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাটি ফেলে পুরো ভরাট করে ফেলা হয়েছে পুকুরটি। চারপাশে সিটি করপোরেশনের নির্মাণ করা গার্ডওয়াল ও রেলিং এখনও রয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, চলতি বছরের শুরুতে পুকুর খননের পরই পূর্ব ও উত্তর পাশের আরসিসি গার্ডওয়ালসহ রাস্তা ধসে পড়ে। আশপাশের একাধিক বহুতল ভবনের দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। এরপর বন্ধ হয়ে যায় সংস্কার কাজ।
২০১৮ সালে পুকুর সংস্কারের কাজটি পেয়েছিল পিনু অ্যান্ড কানু নামের এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পরে তৎকালীন কাউন্সিলর দিনার খান হাসু ঠিকাদারের কাছ থেকে কিনে নিয়ে নিজে কাজটি করান।
কাউন্সিলর নিজে ঠিকাদার হওয়ায় তার ইচ্ছেমতো কাজ করেন বলে অভিযোগ আছে। তিনি বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর এসএম শওকত আমীন তৌহিদ বলেন, ‘পুকুরটি খননের সময় এস্কেভেটর দিয়ে অতিরিক্ত মাটি উত্তোলনের কারণে চারপাশের আরসিসি ওয়াল ও রাস্তা ধসে পড়ে। এতে আশপাশের ভবনেও ফাটল দেখা দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে পুকুরটি ভরাট করে দিতে হয়।’
ভরাটের আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হয়েছে বলেও দাবি এই জনপ্রতিনিধির।
তবে পুকুর ভরাটের ব্যাপারে ভিন্ন কথা বলেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পুকুরটি মসজিদের মালিকানাধীন। মসজিদ কমিটি থেকে পুকুরটি ভরাটের জন্য আমাদের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। মসজিদের আয়ের জন্য তারা এখানে মার্কেট করতে চান। তাদের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে।’
পুকুর ভরাটে আইনি নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আইনের নিষেধের কথা আমরা জানি। আমরাও পুকুরসহ কোনো জলাশয় ভরাট করার পক্ষে নই। বরং সিটি করপোরেশন নগরীর ছড়া-দিঘি উদ্ধারে কাজ করছে। কিন্তু এই পুকুরটি ছোট হওয়ায় ও খননের সময় ফাটল দেখা দেয়ায় মসজিদ কমিটির আবেদন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।’