বিবিসি আর্থ-এ প্রকাশিত মাইকেল মার্শালের দ্য সিক্রেট অফ হাউ লাইফ অন আর্থ বিগ্যান অবলম্বনে এই লেখা। এবার থাকছে চতুর্থ পর্ব।
১৯৬০ সাল থেকেই বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে তিনটি চিন্তাধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। একপক্ষ মনে করেছিলেন প্রাণের সূচনা হয়েছিল আরএনএ অণুজীব থেকে।
কিন্তু শুধু মতামত দিয়েই তারা ক্ষান্ত ছিলেন না, তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন কীভাবে আরএনএ বা তার সমগোত্রীয় অণুজীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীর প্রথম দিকের পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই আদি প্রাণ কীভাবে নিজেরা নিজেদের প্রতিলিপি সৃষ্টি করেছিল তা প্রমাণে।
শুরুর দিকে তাদের প্রচেষ্টা যথেষ্ট আশা জাগানিয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের শ্রম হতাশায় পর্যবসিত হয়। যাই হোক, প্রাণ সৃষ্টির গবেষণা এগিয়ে চলছিল কিন্তু সেই সময়ে আরেক দল বিজ্ঞানী যারা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন তারা বুঝতে পারলেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উপায়ে।
আরএনএ ওয়ার্ল্ড তত্ত্বনির্ভর করে একটি সাধারণ ধারণার ওপর; আর সেটা এই যে, কোনো জীবন্ত প্রাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তা নিজের পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। বেশির ভাগ জীববিজ্ঞানী এই ধারণার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। ক্ষুদ্র কোষের ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সুবিশাল নীল তিমি পর্যন্ত সব জীবিত প্রাণীই বংশ বৃদ্ধি করতে তৎপর।
তবে অনেক ‘প্রাণের উৎস সন্ধানী’ গবেষক বংশ বিস্তারই প্রাণীর প্রধান বৈশিষ্ট্য বলে মনে করতেন না। তাদের যুক্তি ছিল বংশ বিস্তারের আগে সেই সকল প্রাণকে প্রথমে টিকে থাকার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই জীবিত থাকতে হবে।
আমরা আমাদের বাঁচিয়ে রাখি খাবার খেয়ে। একইভাবে সবুজ উদ্ভিদ বেঁচে থাকে সূর্যালোক থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে শক্তি আহরণ করে। আপনার এ রকম চিন্তা করার সুযোগ নেই যে একজন মানুষ নিজের শক্তির জোগানের জন্য পত্রপল্লবিত একটা ওক গাছের শাখায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে, যেমনভাবে নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুস্বাদু রসালো মাংসের হাড়ের ওপর। কিন্তু আপনি যদি গভীরভাবে চিন্তা করেন তো দেখবেন মানুষ আর নেকড়ে উভয়ই বেঁচে থাকার শক্তি আহরণ করছে একই পদ্ধতিতে।
খাবার খেয়ে তা থেকে শক্তি উৎপাদনের এই প্রক্রিয়াকেই বলে বিপাক প্রক্রিয়া। প্রথমে আপনাকে শক্তি আহরণ করতে হবে। এরপর সেই শক্তি থেকেই তৈরি হবে নতুন দেহকোষ। শক্তি আহরণের এই প্রক্রিয়াকেই অনেক বিজ্ঞানী প্রাণ গঠনের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এবং প্রথম প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল এই প্রক্রিয়া দিয়েই, এমন সিদ্ধান্তও দেন তারা।
শুধু খাদ্য গ্রহণ আর বিপাকনির্ভর আদি অণুজীব দেখতে কেমন ছিল? ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে জার্মান বিজ্ঞানী গুন্টার ভাস্টারশাওজার এ ব্যাপারে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। জার্মান রসায়নবিদ গুন্টার ভাস্টারশাওজার ধারণা করেন, প্রথম অণুজীব ছিল বিস্ময়করভাবে নতুন কোনো অণুজীব, যেটা আমাদের জানাশোনার বাইরে। তিনি বলেন, প্রথম অণুজীব কোনো কোষ দিয়ে গঠিত ছিল না। তাদের এনজাইম, ডিএনএ বা আরএনএ বলে কিছু ছিল না।
গুন্টার ভাস্টারশাওজারের ধারণা, আদি পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল গরম লাভামিশ্রিত পানির স্রোত। লাভামিশ্রিত সেই পানিতে ছিল অ্যামোনিয়া গ্যাস, খনিজ উপাদান। যখন লাভামিশ্রিত খনিজ পানি পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলো, তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে শুরু করল। বিশেষত, লাভামিশ্রিত পানির মধ্যে দ্রবীভূত খনিজ ও ধাতব উপাদান প্রথম দিকের জৈবকণা গঠনে সাহায্য করেছিল যারা বিভাজন প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর জৈবকণায় পরিণত হয়।
বিপাক ক্রিয়ার চক্রের সৃষ্টি হওয়া ছিল প্রাণ বিকাশের প্রথম বড় ঘটনা। এই প্রক্রিয়ায় একটি রাসায়নিক উপাদান কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে পরিণত হয়। মূল রাসায়নিক উপাদানটিও পুনরায় সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এই প্রক্রিয়া চলাকালে শক্তি উৎপন্ন হয়ে পুরো সিস্টেমে সঞ্চারিত হয়। আর সেই শক্তি থেকেই আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদানসহ একটি প্রাণকোষ সৃষ্টি হয়।
বিপাক প্রক্রিয়া ঠিক প্রাণ না হলেও গুন্টার ভাস্টারশাওজার একে প্রাণ সৃষ্টির পূর্ব শর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করলেন এবং লিখলেন ‘বিপাক প্রক্রিয়াকে প্রায় জীবন্ত কর্মকাণ্ড বলা যায়।‘
শক্তি উৎপাদনের এই বিপাক প্রক্রিয়া প্রতিটি প্রাণীদেহেরই মৌলিক কাজ। আপনার দেহের কোষগুলো একেকটা রাসায়নিক প্রসেসিং প্লান্টের মতো, যেখানে প্রতিনিয়তই একটি রাসায়নিক থেকে আরেকটি নতুন রাসায়নিক তৈরি হচ্ছে। শুধু এই বিপাক প্রক্রিয়াকেই হয়তো প্রাণ বলা যায় না, কিন্তু তা প্রাণের ভেতরকার মৌলিক কর্মকাণ্ড। বিপাক প্রক্রিয়াকে ভাস্টারশাওজার প্রাণ সৃষ্টির পূর্ব শর্ত হিসেবে আখ্যায়িত করলেন এবং বললেন ‘বিপাক প্রক্রিয়াকে প্রায় জীবন্ত কর্মকাণ্ড বলা যায়।‘
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে ভাস্টারশাওজার তার নিজের তত্ত্বের ওপর বিস্তারিত কাজ করেছেন। তিনি রীতিমতো খাতা-কলমে দেখিয়ে দিলেন ভূমির উপরিভাগের জন্য কোনো খনিজ উপাদান ভালো কাজ করে এবং সেখানে কোনো রাসায়নিক চক্র বিক্রিয়া করে। তার উদ্ভাবিত তত্ত্ব সমর্থকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো। কিন্তু তার গবেষণা এখন পর্যন্ত তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভাস্টারশাওজারের দরকার ছিল তার তত্ত্বের বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা আবিষ্কার যা তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তবে আশার কথা হলো, প্রায় এক দশক আগেই তার তত্ত্বের সপক্ষে কিছু আবিষ্কার ঘটে গেছে।
১৯৭৭ সালে ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যাক করলিসের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বপ্রান্তে ডুবো নৌকায় চড়ে ১.৫ মাইল গভীর তলদেশে যান। তারা গালাপোগাসের উষ্ণ উর্বর অঞ্চলে জরিপ পরিচালনা করেন, যেখানে মহাসাগরের তলদেশের বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ পাথুরে পাহাড়ের খাঁড়ি। খাঁড়িগুলো ছিল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ। প্রতিটি জ্বালামুখই ছিল এক প্রকারের প্রাচীন গরম ঘন তরল উদগিরণের আধার।
জ্যাক করলিস এবং তার গবেষক দল দেখতে পেল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে উষ্ণ ঝরনাধারা। অসংখ্য ছিদ্রপথ দিয়ে খনিজসমৃদ্ধ ঘন গরম তরল প্রবাহিত হচ্ছে। অবাক কাণ্ড হলো, এইসব গরম তরল জ্বালামুখের আশপাশে কিছু অদ্ভুত জলজ প্রাণীর প্রচুর আনাগোনা। সেখানে বিপুল পরিমাণ ঝিনুক, শামুক, টিউব-ওয়ার্ম, কোরালের ঘনবসতি। এই এলাকার পানিতে ব্যাকটেরিয়ায় সয়লাব। সব প্রাণীই গরম তরল জ্বালামুখ থেকে উৎসারিত শক্তি ব্যবহার করে বেঁচে আছে।
এই গরম তরল জ্বালামুখ আবিষ্কারকে করলিসের নামে নামকরণ করা হয়। গরম তরল জ্বালামুখের আবিষ্কার তাকে নতুন চিন্তার দিকে টেনে নিয়ে গেল। ১৯৮১ সালে তিনি তত্ত্ব দিলেন ৪০০ কোটি বছর আগের পৃথিবীতেও একই ধরনের গরম তরল জ্বালামুখের অস্তিত্ব ছিল এবং ঠিক সেখানেই প্রাণের সূচনা ঘটেছিল।
করলিস দাবি করেন, গরম তরলের জ্বালামুখ অনেক রাসায়নিকের জটিল যৌগ সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিটি জ্বালামুখ আদি পৃথিবীর সে গরম স্যুপের মতো থকথকে বস্তু বের করে দিচ্ছিল। ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা লাভা মিশ্রিত গরম তরল পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রচণ্ড তাপ এবং চাপে সরল জৈবকণা ভেঙে জটিল-যৌগ থেকে ক্রমাগত জটিলতর অ্যামাইনো অ্যাসিড, নিউক্লিওটায়েড এবং সুগার তৈরি হয়। এরপর সেই তরল সমুদ্রসীমার কাছাকাছি এসে আরও ঠান্ডা হলে শর্করা, প্রোটিন এবং ডিএনএ তৈরি হয়।
সমুদ্রের পানিতে গিয়ে সেটি আরও ঠান্ডা হয়ে পূর্ণ প্রাণকোষ সৃষ্টি হয় এবং সরল এককোষী প্রাণী সৃষ্টি হয়। করলিসের এই প্রস্তাবনা অনেক নিখুঁত এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু স্ট্যানলি মিলার এতে আপত্তি তুললেন। ১৯৮৮ সালে তিনি লিখলেন, জ্বালামুখ যে পরিমাণ গরম থাকে তাতে সেখানে অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি হলেও তা আবার ধ্বংসও হয়ে যাওয়ার কথা। প্রচণ্ড তাপে অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রধান উপাদান চিনিজাতীয় শর্করা বড়জোর কয়েক সেকেন্ড টিকে থাকতে পারবে। তদুপরি এইসব সরল জৈবকণা নিজেদের মাঝে বন্ধন তৈরি করতে পারে না। কারণ, গরম তরল জ্বালামুখের চারপাশের পানি এত গরম যে জৈব-কণার বন্ধন মুহূর্তে ভেঙে দেয়।
ঠিক সেই সময়ে প্রাণের উৎসের সন্ধানে গবেষণার যুদ্ধে যোগ দিলেন ফ্রান্সের গ্রেনোবল ইউনিভার্সিটির গবেষক মাইকেল রাসেল। তার কাছে মনে হলো, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশই ভাস্টারশাওজারের জৈবকণা উৎপন্ন হওয়ার সূতিকাগার। এই অনুপ্রেরণা থেকেই রাসেল প্রাণের উৎপত্তির রহস্য সমাধানে গবেষণার সর্বজন স্বীকৃত একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে ফেললেন। রাসেল তত্ত্ব দিলেন প্রাণের বিকাশ ঘটেছে সমুদ্রের তলদেশে।
মাইকেল রাসেল তার জীবনের শুরুর দিকে ব্যথানাশক এসপিরিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান নিয়ে গবেষণায় সময় কাটিয়েছিলেন। এর মধ্যেই ১৯৬০ সালে ঘটে গেল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই সময়ে রাসেল একটা আগ্নেয়গিরির সম্ভাব্য অগ্ন্যুৎপাত মোকাবিলাকারী দলের সমন্বয় করছিলেন, যদিও অগ্ন্যুৎপাত মোকাবিলা করার জন্য তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না।
কিন্তু তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কীভাবে বদলে যায় সে বিষয়টি। ভূতত্ত্বের এই পরিবর্তনের আঙ্গিকেই তিনি পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে হলো তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিলেন।
১৯৮০ সালে তিনি অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পাশ থেকে জীবাশ্ম পেয়ে গেলেন, যেখানকার তাপমাত্রা ছিল ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। রাসেল যুক্তি দেখালেন, অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার কারণেই আরও বেশি সময় ধরে জৈব-কণার টিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও মুলার ধারণা করেছিলেন সেখানে জৈব-কণার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকবে কম সময় ধরে।
এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রার জ্বালামুখের কাছে প্রাপ্ত ফসিলে কিছু অদ্ভুত জিনিসের সন্ধানও পাওয়া গেল। ফসিলে লোহার আকরিক পাইরাইট এবং সালফার দিয়ে গঠিত এক মিলিমিটার দীর্ঘ গোলাকার খনিজের উপস্থিতি ছিল। রাসেল তার ল্যাবরেটরিতে ফসিল পরীক্ষা করে দেখতে পেলেন পাইরাইট নিজেই গোলাকার ঘন খনিজ তরলের বুদবুদ তৈরি করতে পারে। তিনি পরামর্শ দিলেন প্রথম জটিল জৈব-কণা গঠিত হয়েছিল এইসব সাধারণ পাইরাইট আকরিকের মধ্যে।
একই সময়ে ভাস্টারশাওজার প্রাণের উৎপত্তির গবেষণায় তার ধারণা প্রকাশ করতে লাগলেন। তার মতবাদ ছিল, খনিজের ওপর প্রবাহিত রাসায়নিক পদার্থসমৃদ্ধ গরম স্রোতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এমনকি তিনি প্রস্তাব করেন যে প্রাণের সূচনায় পাইরাইটের ভূমিকা ছিল।
রাসেল এখানে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছেন। তিনি বলেন, সমুদ্রের গভীরে গরম তরল জ্বালামুখের চারপাশের সহনীয় গরম পানিতে নরম জেলিসদৃশ বস্তু পাইরাইটের কাঠামো গঠনের জন্য উপযুক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করে। ভাস্টারশাওজারের প্রস্তাবিত জৈবকণা সৃষ্টির জন্য পাইরাইট বুদবুদ পূর্বশর্ত। যদি রাসেলের গবেষণা সঠিক হয় তাহলে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল সমুদ্রের গভীর তলদেশে এবং সেখানেই প্রথম জৈব-কণার পরিপাকতন্ত্র বা বিপাক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
মিলারের সেই ঐতিহাসিক (উরে-মিলার) পরীক্ষার ৪০ বছর পরে ১৯৯৩ সালে রাসেল তার গবেষণা প্রকাশ করেন। যদিও গণমাধ্যমে রাসেলের গবেষণার ফলাফল নিয়ে উরে-মিলার পরীক্ষার মতো তেমন মাতামাতি হলো না, কিন্তু তার গবেষণা প্রাণের উৎস সন্ধানের আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল। ভাস্টারশাওজারের বিপাক ক্রিয়ার চক্র এবং করলিসের গরম তরলের জ্বালামুখের মতো দুটো দৃশ্যত ভিন্ন ধারণাকে রাসেল একসঙ্গে সমন্বয় সাধন করেন, যার ফলে বিষয়টা আরও বোধগম্য হলো।
রাসেল গবেষণাকে আরও হৃদয়গ্রাহী করতে তার পরীক্ষণের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, কীভাবে প্রথম জৈবকণা শক্তি সঞ্চার করেছিল। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি দেখান কীভাবে জৈবকণার পরিপাকক্রিয়া কাজ করে। তার এই ধারণা আধুনিক বিজ্ঞানের ভুলে যাওয়া মেধাবীদের একজনের কাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
- আরও পড়ুন: পৃথিবীতে প্রাণ রহস্যের সমাধান আর কতদূর?
১৯৬০ সালের দিকে জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী পিটার ডেনিস মিচেল অসুস্থ হয়ে পড়লে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তার পরিবর্তে কর্নওয়ালের এক নীরব অঞ্চলের ম্যানর হাউসে ব্যক্তিগত গবেষণাগার স্থাপন করেন। তখন বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ের সংস্পর্শের বাইরে থাকতেন তিনি। তার গবেষণার খরচের বিরাট অংশ আসে একপাল গরুর দুধ বিক্রির টাকা থেকে। অনেক জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী, যেমন, লেসলি ওরগেল, যার আরএনএ সংক্রান্ত কাজ নিয়ে আগে আলোচনা করা হয়েছে, তিনি মিশেলের গবেষণার কাজকর্মকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন।
কিন্তু এখন আমরা জানি, পিটার মিশেল যে প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন পৃথিবীর সমস্ত জীবন্ত প্রাণীকুল সেটাই ব্যবহার করে। দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে মিচেল চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেন। ১৯৭৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি। মিশেলের নাম হয়তো দৈনন্দিন গৃহস্থালি জীবনে কখনও দেখা পাওয়া যায় না, কিন্তু তার নাম লেখা আছে জীববিজ্ঞানের প্রতিটি পাঠ্যবইতে।
পিটার মিশেল তার পেশাগত জীবন কাটালেন কোনো প্রাণ খাদ্য থেকে যে শক্তি সঞ্চয় করে তা দিয়ে সে আসলে কী করে, সে বিষয়ের অনুসন্ধানে। তার একটাই জিজ্ঞাসা ছিল, কীভাবে আমরা প্রতি মুহূর্তে বেঁচে থাকি?
তিনি জানতেন প্রতিটি দেহকোষ তাদের শক্তি সঞ্চিত রাখে একটি মলিকিউলের মধ্যে; যাকে আমরা এডেনোসাইন ট্রাইফসফেট (এটিপি) বলি। ফসফেটের তিনটি রাসায়নিক অণুর মেলবন্ধনে একত্রিত হয়ে আছে এডেনোসাইন। এদের মধ্যে ফসফেটের তৃতীয় অণুটি বেশি শক্তি গ্রহণ করে এটিপির সঙ্গে মিলিত হয়।
যখন কোনো একটা কোষের শক্তি প্রয়োজন হয়- ধরে নিই, যদি মাংসপেশির কোনো কাজ করার প্রয়োজন হয় তখন এটিপি থেকে ফসফেটের তৃতীয় অণু ভেঙে যায়, ফলে বাকি দুটি অণু মিলে এডেনোসাইন ডাইফসফেট (এডিপি) তৈরি হয় এবং শক্তি উৎপাদিত হয়।
মিশেল জানতে চাইলেন প্রাণীদেহের কোষ কীভাবে প্রথমে এটিপি তৈরি করেছিল। কীভাবেইবা কোষের শক্তি এডিপিতে সঞ্চিত হলো, যার ফলে ফসফেটের তৃতীয় অণুটি কোষে যুক্ত হয়?
মিশেল জানতেন, যে এনজাইম এটিপি গঠন করেছে সেটা কোষের পাতলা আবরণের ওপরে অবস্থান করে। তাই তিনি প্রস্তাব করেন, কোষ এনজাইমের পাতলা আবরণের ওপর থেকেই চার্জযুক্ত অণু প্রোটন কণা থেকে শক্তি সঞ্চার করে। সুতরাং আবরণের একপাশে থাকে প্রচুর প্রোটন-কণা এবং অপর প্রান্তে হয়তো কিছুই থাকে না।
কোষের উভয় দিকে প্রোটন-কণার সমতা আনার জন্য প্রোটন-কণার প্রবাহ তখন আবরণের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রোটন-কণাগুলোকে এনজাইম ভেদ করে যেতে হয়। এনজাইমকে অতিক্রম করে যাওয়ার সময় প্রোটন-কণার প্রবাহ এনজাইমকে এটিপি গঠনের প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে যায়।
মিশেল কোষের শক্তি সঞ্চয়ের ধারণাকে প্রকাশ করেন ১৯৬১ সালে। পর্যাপ্ত প্রমাণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এরপরের ১৫ বছর তিনি ব্যয় করেন কোষ কীভাবে কাজ করে, তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে। এখন আমরা সকলেই জানি প্রতিটি জীব কোষ কীভাবে বেঁচে আছে যেটা মিশেল সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন। ঠিক এই মুহূর্তে আপনার শরীরের প্রতিটি কোষে একই প্রক্রিয়া চলছে। ঠিক যেমন আমরা সবাই জানি ডিএনএ প্রাণের মূল উপাদান।
যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা মাইকেল রাসেল উত্থাপন করেন, সেটা হলো- পিটার মিশেলের প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট। কোষের গায়ে ঝিল্লির মতো পাতলা আবরণের এক প্রান্তে প্রচুর প্রোটন থাকে আর অপর প্রান্তে প্রোটন সংখ্যায় প্রায় নগণ্য। শক্তি সঞ্চয় করে রাখার জন্য প্রতিটি কোষেরই প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট দরকার হয়।
এখনকার আধুনিক কোষগুলো পাতলা ঝিল্লির মতো আবরণের ভেতর দিয়ে প্রোটন প্রবাহিত করে তা থেকে গ্র্যাডিয়েন্ট গঠন করে। কিন্তু এর জন্য জটিল প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া দরকার, যা হুট করেই প্রাণের মধ্যে উঁকি দেয়নি। এই পর্যায়ে মাইকেল রাসেল প্রাণ বিকাশের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তির ধাপ অতিক্রম করলেন। তিনি বললেন, প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক কোনো স্থানের প্রোটনের গ্র্যাডিয়েন্ট থেকে।
প্রাকৃতিক সেই স্থানটা হতে পারে গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখের এলাকা। কিন্তু সেই জ্বালামুখ ছিল বিশেষ এক ধরনের, যখন পৃথিবী সবে সদ্যোজাত শিশু এবং তার সমুদ্রগুলোর পানি ছিল তীব্র ক্ষারযুক্ত। আমরা জানি, ক্ষারযুক্ত পানিতে প্রচুর প্রোটন কণা ভাসতে থাকে। প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট সৃষ্টির জন্য জ্বালামুখ থেকে প্রবাহিত পানিতে অবশ্যই পরিমাণে অল্প প্রোটনের উপস্থিতি থাকতে হবে; এবং সে পানিকে হতে হবে স্বল্প ক্ষারযুক্ত।
কিন্তু এ জন্য জ্যাক করলিসের আবিষ্কৃত গরম তরল প্রবাহের জ্বালামুখ আশানুরূপ কার্যকর ছিল না। তার আবিষ্কৃত জ্বালামুখের এলাকা ছিল খুব উত্তপ্ত আর অত্যধিক ক্ষারযুক্ত। কিন্তু ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ওশেনোগ্রাফির অধ্যাপক দেবরাহ কেলি ২০০০ সালে প্রথম স্বল্প ক্ষারযুক্ত জ্বালামুখের সন্ধান পান।
কেলিকে বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য প্রথম দিকে প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে। হাইস্কুলে লেখাপড়া চলাকালে তার বাবা মারা যান, ফলে কলেজের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করার জন্য তাকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হতো। কিন্তু তার পরিশ্রম সফল হয়েছিল এবং তিনি সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরি আর উত্তপ্ত তরল প্রবাহের জ্বালামুখের গবেষণায় আকৃষ্ট হন। এই দুটো আগ্রহের প্রতি ভালোবাসা তাকে নিয়ে গেল আটলান্টিক মহাসাগরের অতল গভীরে, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠ বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে যাচ্ছে পরস্পর থেকে দূরে এবং সমুদ্রের তল থেকে জেগে উঠছে পর্বতের খাঁড়ি।
পাহাড়ের খাঁজগুলোতে দেবরাহ কেলি পেয়ে গেলেন উত্তপ্ত পানি প্রবাহের জ্বালামুখের ক্ষেত্র, যাকে তিনি ‘লুপ্ত নগরী’ হিসেবে অভিহিত করলেন। এই জ্বালামুখগুলো করলিসের আবিষ্কৃত জ্বালামুখের মতো নয়। এখানের জ্বালামুখ দিয়ে প্রবাহিত পানির উষ্ণতা মাত্র ৪০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে এবং পানিতে ক্ষারের উপস্থিতিও খুব সহনীয় মাত্রায়। সেখানের পানিতে কার্বনমিশ্রিত খনিজ স্তূপ ক্রমশ খাড়া হয়ে ওপরের দিকে প্রবাহিত হয়, যেগুলো দেখতে অনেকটা চিমনির সাদা ধোঁয়ার মতো। সমুদ্রের তলদেশের পর্বতের খাঁড়ি থেকে উত্থিত সাদা ধোঁয়াকে মনে হচ্ছিল যেন গোলাকার জীবন্ত কোনো পাইপসদৃশ বস্তু। সেই পাইপের চেহারা অদ্ভুত এবং যেন মনে হয় ভূতের মতো। যদিও এটা ছিল বিভ্রান্তিকর। কারণ, এখানেই, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের এই ঘন তরলেই জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য ক্ষুদ্র অণুজীব।
স্বল্প ক্ষারসমৃদ্ধ আগ্নেয়গিরির এইসব জ্বালামুখই ছিল মাইকেল রাসেলের তত্ত্ব প্রমাণের জন্য উপযুক্ত স্থান। তিনি বুঝতে পারলেন লুপ্ত নগরীর আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলোর উত্তপ্ত তরল প্রবাহের এলাকাতেই প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।
কিন্তু তার একটি সমস্যা ছিল। যেহেতু রাসেল ছিলেন মূলত ভূতাত্ত্বিক, সেই কারণেই তার তত্ত্বকে বোধগম্য এবং প্রমাণ করার জন্য কোষ কীভাবে কাজ করে সেটা হাতে-কলমে দেখানোর মতো জীববিজ্ঞানের পর্যাপ্ত জ্ঞান তার ছিল না। সুতরাং রাসেল তার গবেষণা দলে ডাকলেন আমেরিকান জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম মার্টিনকে।
উইলিয়াম মার্টিন একজন অতি উৎসাহী গবেষক, যিনি তার পেশাজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন জার্মানিতে উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং অণুজীববিজ্ঞানের পঠন পাঠনে। বর্তমানে তিনি জার্মানির ডুসেলডর্ফে হাইনরিখ হাইনে ইউনিভার্সিটির মলিকিউলার ইভোল্যুশন ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। ২০০৩ সালে রাসেল এবং মার্টিন মিলিতভাবে রাসেলের পূর্বের তত্ত্বকে আরও উন্নতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করলেন। এখন পর্যন্ত প্রাণের উৎস সন্ধানে যত গবেষণা হয়েছে এবার যেন সেই গবেষণার কঙ্কালে রক্তমাংসের ছোঁয়া লাগল। তাদের তত্ত্ব বিজ্ঞানী সমাজে প্রাণের উৎস গবেষণায় এযাবৎকালের অন্যতম গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে মর্যাদা পেয়ে গেল।
দেবরাহ কেলিকে ধন্যবাদ, রাসেল এবং মার্টিনের গবেষক দল এখন দেবরাহ কেলির কল্যাণে জানতে পেরেছেন স্বল্প ক্ষারসমৃদ্ধ পাথরের জ্বালামুখে ছিল অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট চুনাপাথরের স্তর, যেখান দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে পারত। পাথরের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্রে পানি পূর্ণ ছিল। পানি-পূর্ণ এইসব ছোট ছোট ছিদ্র প্রাথমিক কোষের কাজ করত বলে ধারণা করেন তারা। প্রতিটি ছিদ্র প্রয়োজনীয় রাসায়নিক এবং পাইরাইট খনিজ উপাদানে পূর্ণ ছিল। এর সঙ্গে ছিল জ্বালামুখ থেকে আসা প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট। এ রকম পরিবেশই হলো প্রাণকোষের শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিপাক ক্রিয়া শুরু হওয়ার উপযুক্ত স্থান।
রাসেল এবং মার্টিন বললেন, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পানি থেকে রাসায়নিক শক্তি সংগ্রহ করে প্রাণ যখন সবে যাত্রা শুরু করে, তখনই আরএনএ অণুজীবের সৃষ্টি প্রক্রিয়াও শুরু হয়। এমনকি তখনই ঝিল্লির মতো পাতলা আবরণ সৃষ্টি করে একটা সত্যিকারের জীবকোষ বা প্রাণ হয়ে ওঠে। কোষের জন্ম সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোষ পাথরের ছিদ্র ছেড়ে পানিতে যাত্রা শুরু করে।
এই তত্ত্ব এখন প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত নেতৃস্থানীয় তত্ত্বগুলোর একটি হিসেবে গণ্য হয়।
রাসেলের গবেষণার কিছু আলোচ্য বিষয় ঘষেমেজে মার্টিন ২০১৬ সালে নতুন করে ‘প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ’ শিরোনামের আর্টিকেলটি প্রকাশ করেন। চারিদিকে হইচই পড়ে যায় এবং বিশাল সমর্থনও অর্জন করেন মার্টিন। প্রকৃতির গর্ভ থেকে শত শত কোটি বছর আগে জন্ম নেয়া সেই অণুজীব থেকেই পৃথিবীর সব প্রাণীর জন্ম হয়েছে।
কিন্তু প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের জন্য সম্ভবত আমরা কোনোদিনই ‘প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ’ অণুজীবের ফসিল উপস্থাপন করতে পারব না। তবে আমরা আমাদের ইতিপূর্বের পঠন-পাঠন দিয়ে বর্তমানে জীবিত অণুজীব দেখে অনুমান করতে পারব কেমন ছিল দেখতে সেই প্রাচীন অণুজীব আর কেমন ছিল তাদের আচরণ। মার্টিন তাই করলেন।
উইলিয়াম মার্টিন ১ হাজার ৯৩০টি আধুনিক অণুজীবের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেন এবং এমন ৩৫৫টি জিন শনাক্ত করেন যেগুলো তাদের সবার মধ্যেই আছে। মার্টিন বলেন, এই ৩৫৫টি জিন বংশপরম্পরায় একই বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে এবং ১ হাজার ৯৩০টি অণুজীবের পূর্বপুরুষ ‘প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ’ অণুজীব থেকেই এসেছে।
এই ৩৫৫টি জিন আরও কিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রোটন গ্র্যাডিয়েন্ট আহরণ করার জন্য। তদুপরি, ‘প্রথম সর্বজনীন পূর্বপুরুষ’ অণুজীব মিথেনের মতো রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়। এর থেকে প্রমাণিত হয়, অণুজীব জন্ম নিয়েছিল জীবন্ত আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের পরিবেশে।
আরএনএ তত্ত্ব সমর্থকগোষ্ঠী বললেন, সমুদ্রতলে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এই তত্ত্বের দুটো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একটার হয়তো সম্ভাব্য সমাধান বের করা সম্ভব, কিন্তু অন্যটি খুবই গুরুতর।
রাসেল এবং মার্টিনের প্রস্তাবিত তত্ত্বের প্রথম সমস্যা হলো, তাদের তত্ত্ব শুধু ব্যাখ্যা, সেখানে গবেষণাগারে কোনো পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ নেই। তাদের আছে শুধু ধাপে ধাপে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাব্য বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। কিন্তু কোনো বিশ্লেষণই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত নয়।
প্রাণের উৎস সন্ধানী বিজ্ঞানী আরমেন মালকিদজানিয়ান বললেন, যেসব বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন কোষ নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে তারা প্রতিনিয়ত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল তথ্য আকারে প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যারা প্রাণের উৎস গবেষণায় বিপাক ক্রিয়া প্রথম শুরু হয়েছিল মনে করেন, তারা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারছিলেন না।
রাসেল এবং মার্টিনের গবেষণার এই পর্যায়ে এগিয়ে এলেন মার্টিনের সহকর্মী ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রফেসর নিক লেন। তিনি গবেষণাগারে ‘অরিজিন অফ লাইফ রিয়েক্টর’ বানালেন, যা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের স্বল্প ক্ষারযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তিনি অণুজীবের বিপাক ক্রিয়ার চক্র পর্যবেক্ষণ করার আশাও করেন এবং সম্ভবত আরএনএ অণুজীবও।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের অবস্থান গভীর সমুদ্রের তলদেশে। ১৯৮৮ সালে মিলার যেমন দেখিয়েছিলেন, অণুজীবের দীর্ঘ শৃঙ্খল আরএনএ এবং প্রোটিন পানিতে এনজাইমের সাহায্য ছাড়া গঠিত হতে পারে না। প্রাণের উৎস গবেষণার অনেক বিজ্ঞানীদের কাছেই এই যুক্তি অনেক গ্রহণযোগ্য মনে হলো এবং সেখানে রাসেল এবং মার্টিনের তত্ত্ব প্রায় ধরাশায়ী।
আরমেন মালকিদজানিয়ান বললেন, ‘যদি আপনি রসায়ন বিষয়টা একটু পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি গভীর সমুদ্রের তলদেশের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের গরম ঘন তরল প্রবাহ থেকে প্রাণের উৎপত্তি এই তত্ত্ব মেনে নিতে পারবেন না। কারণ, আপনি জানেন এইসব অণুজীবের রসায়ন পানিতে টিকতে পারে না।‘
এত সমালোচনা সত্ত্বেও রাসেল এবং মার্টিনের গবেষক দল তাদের তত্ত্বে অটল থাকলেন। কিন্তু গত এক দশকে ক্রমাগত কয়েকটি অনন্য গবেষণার ফলাফল তৃতীয় আরেকটি তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলো। তৃতীয় তত্ত্বটি বলছে, আরএনএ ওয়ার্ল্ড বা সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের গরম তরলে সৃষ্ট শক্তি উৎপাদনের বিপাক ক্রিয়া থেকে প্রাণের যাত্রা শুরু হয়নি; প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছে শূন্য থেকে সৃষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ কোষ থেকে।
লেখক: সাংবাদিক
jr.tareq@gmail.com
পরের পর্বে থাকছে, পূর্ণাঙ্গ প্রাণকোষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম বিষয়ে