বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

হেফাজতে গৃহদাহ

  •    
  • ২৪ আগস্ট, ২০২১ ১২:৫৮

‘সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমিরকে না করে প্রধান উপদেষ্টা থেকে আমির নির্বাচন করা হলো। প্রধান উপদেষ্টার কাজ হলো আমির নাই, আমির হিসেবে একজনকে নির্বাচন করা, কিন্তু উনি নিজেই আমির হয়ে গেলেন। যেখানে কোনো নিয়মনীতি থাকে না, সেখানে কাজ কতটুকু হবে সেটা আপনারা বুঝে নেন।’

তিন শীর্ষ নেতাকে মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে হারিয়েছে দেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সবশেষ আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন একসময়ে সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ তার ওপর আস্থা রাখলেও তার নেতৃত্ব নিয়ে হেফাজতে ইসলামেই বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

গত বৃহস্প‌তিবার জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর তার জানাজাতেই মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে নেতৃত্বে আনার ঘোষণা আসে।

রাত ১১টার দি‌কে হাটহাজারী মাদ্রাসায় জুনায়েদ বাবুনগরীর জানাজায় ভারপ্রাপ্ত আমির পদে তার নাম ঘোষণা করেন হেফাজত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী।

বিষয়টি সে সময় হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতাকেই বিস্মিত করে। আলোচনা না করে কিসের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নেয়া হলো, সেটি নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

হেফাজতের সাবেক নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী এমন প্রশ্ন তুলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি সংগঠনের আমির হন কীভাবে?’

হেফাজতে ইসলামের কোনো গঠনতন্ত্র নেই, সংগঠনের একটি অংশ এ বিষয়টির সুবিধা নিচ্ছে- তাও বলতে ছাড়েননি সংগঠনের সাবেক এই নেতা।

ইউসুফী ২০১০ সালে হেফাজত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনে জড়িত ছিলেন। তবে মার্চের শেষে ও এপ্রিলের শুরুতে সহিংসতার পর সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার পর বাদ পড়েন।

তিনি বলেন, ‘আল্লামা শফী সাহেব কিংবা পরবর্তীতে জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবের দেশব্যাপী একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়েই আমরা কাজ করেছি। কিন্তু নিয়মনীতি আগেও ছিল না, এখনও নাই।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সংগঠনের স্বাভাবিকভাবে সভাপতি মারা গেলে কোনো সিনিয়র সহসভাপতি সেই দায়িত্ব পেলেও হেফাজতে ইসলামে তেমনটি দেখা যায়নি। কিন্তু এগুলো এখানে ফলো করা হয়নি। কোনো অনুষ্ঠানিক ফোরামের বৈঠক ছাড়া আমির নির্বাচন করা হলো।

‘সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমিরকে না করে প্রধান উপদেষ্টা থেকে আমির নির্বাচন করা হলো। প্রধান উপদেষ্টার কাজ হলো আমির নাই, আমির হিসেবে একজনকে নির্বাচন করা। কিন্তু উনি নিজেই আমির হয়ে গেলেন। যেখানে কোনো নিয়মনীতি থাকে না, সেখানে কাজ কতটুকু হবে সেটা আপনারা বুঝে নেন।’

ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পাওয়া মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী সদ্য প্রয়াত জুনাইদ বাবুনগরীর মামা। বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে তিনি হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের কমিটিতে তিনি ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমির।

মুহিবুল্লাহর দুটো বিষয় নিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তার একটি হলো, তার বয়স এখন প্রায় ৯০ বছর। এত বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে কতটুকু সংগঠন পরিচালনা করা সম্ভব হবে এটাই প্রশ্ন। অপরটি হলো, তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন। ফটিকছড়ি থেকে হাটহাজারীকেন্দ্রিক বলয়ের এই সংগঠন তিনি কতটুকু পরিচালনা করতে পারবেন এ বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক গোলাম রাব্বানী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমাদের মহাসচিব অনেক সক্রিয়। আর উনি সভাপতি হিসেবে থাকবেন। আর মহাসচিব তো আছেনই বাকি বিষয়গুলো দেখার জন্য। প্রত্যেক সংগঠনের তো সেক্রেটারি জেনারেলের নেতৃত্বে সংগঠন চলে। ওনার (মহাসচিব) নেতৃত্বও চলবে।’

নতুন আমিরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠন দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আবদান রাখবে। উনি অনেক প্রবীণ আলেম। উনি কওমি অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আমরা আশা রাখতে পারি, ওনার নেতৃত্বে আমরা আমাদের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার জন্য সচেষ্ট থাকব।’

হেফাজতের নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামের বাইরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর তেমন প্রভাব না থাকলেও হাটহাজারী মাদরাসা বলয়ের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পেয়েছেন। আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল, সেখানে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ায় জুনায়েদ বাবুনগরীপন্থিদের বেশ আস্থায় আসেন তিনি। সে বিষয়টি এবার তার নেতৃত্বে আসায় বেশ কাজে দিয়েছে।

মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এর আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাজার নামাজে ইমামতি করে আলোচনায় আসেন তিনি।

গত মার্চে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চাপে পড়া হেফাজত একপর্যায়ে কমিটি বিলুপ্ত করতে বাধ্য হয়। পরে পাঁচ সদস্যের যে আহ্বায়ক কমিটি করা হয় সেখানেও মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ছিলেন।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল আউয়াল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনাকে কীভাবে আমির ঘোষণা দেয়া হলো এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু জানি না। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কেউ পরামর্শও করেননি। পরে শুনেছি, আমাদের মহাসচিব সাহেব সেখানে (হাটহাজারীতে) এমন ঘোষণা দিয়েছেন।’

এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক গোলাম রাব্বানী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যারা সেখানে (হাটহাজারীতে) উপস্থিত ছিলেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সংগঠনের আমির নির্ধারণ করা হয়েছে। যারা সেখানে ছিলেন না তাদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করা হয়েছে।’

জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়েছে আল্লামা মুফতি মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে। ছবি: নিউজবাংলা

সংগঠনে ঐক্য নেই

গত বছরের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হাঙ্গামার কদিনের মধ্যেই আল্লামা শফীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফাটল ধরে সংগঠনে। মাদ্রাসায় হাঙ্গামার সময় তাকে চিকিৎসা দিতে বাধা, এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর পরিবার।

আর শফীর শ্যালক এই ঘটনায় হত্যা মামলা করেন বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এতে অবহেলাজনিত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি।

গত বছরের নভেম্বরে জাতীয় সম্মেলন করে বাবুনগরীকে আমির করে করা কমিটিতে শফীপন্থি কাউকে রাখা হয়নি। এই কমিটিতে স্থান দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক শতাধিক নেতাকে। তারা নতুন কমিটি গঠন করার পর হঠাৎ করেই তারা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকে।

মার্চ মাসে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে নানামুখী হুমকি দিতে থাকেন সরকারকে। ফলে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা দেখা দেয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাণ্ডব ছিল নজিরবিহীন। হেফাজত নেতারা এ সময় বলতে থাকেন, দেশ চালাতে হলে সরকারকে তাদের কথা শুনেই চালাতে হবে।

কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারী সঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হেফাজত নেতারা তাৎক্ষণিক সহিংসতা চালিয়ে ত্রাস তৈরি করলেও কয়েক দিন পরেই পাল্টে যায় পরিস্থিতি। সরকার যখন অভিযান শুরু করে, তখন হেফাজত চুপসে যায়।

নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পর গত ২৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।

নানা নাটকীয়তার পর গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগের কমিটির মধ্যে যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিলেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেয়া হয়।

এই সিদ্ধান্ত এখনও মেনে নেননি হেফাজতের শফীপন্থিরা। আল্লামা শফীর অনুসারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে অবশ্য প্রয়াত আমিরের বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে সহকারী মহাসচিব করা হয়। তবে ওই দিনই ইউসুফ মাদানী তা প্রত্যাখ্যান করেন।

প্রতিষ্ঠার তিন বছর পর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল সমাবেশ করে নিজেদের শক্তি জানান দেয় হেফাজতে ইসলাম। ফাইল ছবি

যেভাবে আলোচনায় হেফাজত

২০১০ সালে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে সংগঠনটির যাত্রা। তবে সংগঠনটি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করে ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে। শাহবাগ থেকে ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি হচ্ছে এমন অভিযোগ তুলে ওই বছরের ৬ এপ্রিল সংগঠনটি ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করে।

তাদের এই শোডাউন ব্যাপক নজর কাড়ে বিভিন্ন মহলের। তবে এর ঠিক এক মাস পর ৫ মে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচিতে শাপলা চত্বরে অবস্থানকালে মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পালাতে বাধ্য হন হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। এরপর সংগঠনটি অনেকটা চুপসে যায়।

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। তার ব্যক্তিত্বের কারণে সারা দেশের মানুষ তাকে সমীহ করতেন।

পরে সরকারের সঙ্গেও দেশের শীর্ষ এই আলেমের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার নেতৃত্বেই কওমি মাদ্রাসা দাওরায়ে হাদিসের সনদের সরকারি স্বীকৃতি পায়। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরিয়া মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধিও দেয়া হয়। তবে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে রাজনৈতিক আলেমদের নিয়ন্ত্রণ চলে আসায় সংগঠনটি সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়।

এ বিভাগের আরো খবর