দীর্ঘদিন ধরেই মাঠে নেই সিলেট বিএনপি। নেই তেমন কোনো কর্মসূচি। নেতাদের বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয়। তবে নিজেদের মধ্যে বিরোধে ঠিকই চাঙা দলটি। অভ্যন্তরীণ বিবাদে দলের অঙ্গসংগঠনে এখন চলছে পদত্যাগের হিড়িক।
সিলেট বিএনপিতে এই অন্তঃকোন্দল অনেক দিনেরই। সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এই কোন্দল প্রকাশ্যে আসে।
নবগঠিত কমিটির ১১ নেতা ও মহানগর তাঁতী দলের তিন নেতা সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। আরও অনেকে পদত্যাগ করতে পারেন বলে জানা গেছে। এসব কারণে মাঠে নিষ্ক্রিয় থেকেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে সিলেট বিএনপির রাজনীতি।
এ নিয়ে বিএনপির সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি। তবে পদত্যাগের ওই ঘটনায় তারা বিব্রত বলে জানিয়েছেন।
সিলেট জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি গত ১৭ আগস্ট অনুমোদন দেয় দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি-সম্পাদক। কমিটিতে জেলা শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুল আহাদ খান জামাল ও সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক ছাত্রনেতা দেওয়ান জাকির হোসেন খান।
মহানগর শাখার আহ্বায়ক হিসেবে আব্দুল ওয়াহিদ সুহেল ও সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আজিজুল হোসেন আজিজ।
নিজেদের বলয়ের নেতারা কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়ায় এই কমিটি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন জেলা বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা। কমিটি ঘোষণার পরদিনই বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জামান জামান পদত্যাগের ঘোষণা দেন। দলের মহাসচিব বরাবর পদত্যাগপত্রও ওই দিন পাঠান তিনি।
পদত্যাগপত্রে তিনি অভিযোগ করেন, সহ-স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক হওয়ার পরও তার সঙ্গে আলোচনা না করেই জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি অনুমোদন করা হয়। তাতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।
জামানের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই নবগঠিত জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ১১ নেতা।
তারা হলেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এমদাদ বক্স, সদস্য মওদুদুল হক, শহীদুল ইসলাম কাদির, আলতাফ হোসেন বিল্লাল, আমিনুল হক বেলাল ও শাহিদুল ইসলাম চৌধুরী লাহিন এবং মহানগর কমিটির সদস্য আব্দুর রকিব তুহিন, রুজেল আহমদ চৌধুরী, আব্দুল হান্নান ও আক্তার আহমদ। তারা গত ২১ আগস্ট কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শামসুজ্জামান জামান
এ বিষয়ে মহানগর কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রকিব তুহিন বলেন, ‘নতুন কমিটিতে যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। নিষ্ক্রিয় ও অযোগ্যদের দিয়ে একটি পকেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি আমাদের হতাশ করেছে। তাই আমরা পদত্যাগ করেছি।’
এর দুই দিন পর পদত্যাগ করেন বিএনপির সহযোগী সংগঠন তাঁতী দলের তিন নেতা। তারা হলেন মহানগর তাঁতী দলের সভাপতি ফয়েজ আহমদ দৌলত, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল গফফার।
আব্দুল গফফার বলেন, ‘যে দলে মূল্যায়ন নাই, গণতন্ত্রের আভাস নাই, সেখানে রাজনীতি করে যাওয়া কঠিন। আমরা শহীদ জিয়ার যে আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করতাম, তা এখন দেখতে পাচ্ছি না।
‘আমাদের কর্মীরা মূল্যায়ন পাচ্ছে না। যারা নির্যাতিত হয়েছে, হামলা-মামলার শিকার হয়েছে, তারা যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না। তাই পদত্যাগ করেছি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অঙ্গসহযোগী সংগঠন থেকে পদত্যাগকারী সবাই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা শামসুজ্জামান জামানের অনুসারী। তার পদত্যাগের ঘোষণার পরই পদত্যাগ করছেন অন্যরা। সে পথে আরও কয়েকজন নেতা হাঁটতে পারেন বলেও জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে পদত্যাগ করা তাঁতী দল নেতা আব্দুল গফফার বলেন, ‘জামান ভাই ত্যাগী নেতা। রাজপথের ইলিয়াস ভাইয়ের (ইলিয়াস আলী) পরেই আন্দোলন-সংগ্রামে জামান ভাইয়ের অবদান বেশি। তার মূল্যায়ন না হলে... তার তুলনায় আমরা তো বহু নিচে। জামান ভাইয়ের মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরা দুঃখ পেয়েছি।’
সিলেট জেলা ও মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটি গত বছর ঘোষিত হয়। তাতে নিজেদের পছন্দের লোক ঠাঁই না পাওয়ায় পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক, শামসুজ্জামান জামানসহ সিলেটের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। পরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপে এই সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে আসেন। এর আগে জেলা ও মহানগর ছাত্রদলের কমিটি নিয়েও এ ধরনের ক্ষোভ দেখা যায়।
বিএনপি নেতারা জানান, সিলেট বিএনপি এখন মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের অনুসারী ও তার বিরোধী-বলয়ের মধ্যেই এখন বিরোধ সবচেয়ে তুঙ্গে।
খন্দকার মুক্তাদিরের বিরোধী-বলয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, শামসুজ্জামান জামানসহ কয়েকজন নেতা।
গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। তখন থেকেই মুক্তাদিরের বিরোধিতা করে আসছিলেন মেয়র আরিফুল। আরিফ-বলয়ের নেতারা প্রার্থী হিসেবে চাইছিলেন বর্তমানে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে দলটির উপদেষ্টা হয়ে যাওয়া ইনাম আহমদ চৌধুরীকে।
প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইনাম আহমদ তখন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। তবে দল থেকে খন্দকার মুক্তাদিরকেই প্রার্থী করা হয়। এরপর নানা চেষ্টা করে আরিফের মান ভাঙান মুক্তাদির। কেন্দ্রের চাপে মেয়র আরিফ তখন প্রকাশ্যে মুক্তাদিরের পক্ষে প্রচারে নামলেও আড়ালে মেয়র ও তার অনুসারীরা মুক্তাদিরের বিরুদ্ধে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী (বামে) ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের অনুসারীদের মধ্যে বিভক্ত সিলেট বিএনপি
সেই নির্বাচনে হেরে গেলেও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সঙ্গে খন্দকার মুক্তাদিরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে তার অনুসারী একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এই সম্পর্কের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটিতে মুক্তাদির বলয়ের নেতারাই বেশি প্রাধান্য পান।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক বলেন, ‘দলে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। একটি গোষ্ঠী কেন্দ্রের শীর্ষ নেতাদের ভুল বুঝিয়ে নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠন করছে। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
‘পরীক্ষিত নেতারা বঞ্চিত হওয়ায় অনেকের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এই ক্ষোভ থেকেই জামানসহ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন।’
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
নেতাদের এমন পদত্যাগের ঘোষণাকে বিব্রতকর আখ্যা দিলেও এতে দলে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার।
তিনি বলেন, ‘অনেকের ক্ষোভ থাকতে পারে। এই ক্ষোভ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রকাশ্যে এভাবে পদত্যাগের ঘোষণা শোভন নয়। তবে তাদের এমন ঘোষণায় দলে তেমন প্রভাব ফেলবে না। পদত্যাগকারীরা সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির কোনো দায়িত্বেও নেই।’
মাঠে কোনো কর্মসূচি কেন নেই দলের? জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে এখন রাজপথে কোনো কর্মসূচি নেই। তবে নিয়মিতই আমরা ঘরোয়াভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করি। সংকটে পড়া মানুষের পাশেও আমরা আছি।’