বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশি সংস্থা ইন্টারপোলে যে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল, সেটি এখন আর নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলের রিভিউ আবেদনে নোটিশটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রত্যাহার করা হয়েছে কুমিল্লার মুরাদনগর আসনের সে সময়ের সংসদ সদস্য কাজী মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের বিরুদ্ধে জারি করা নোটিশটিও।
ইন্টারপোলের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক নেতার নামে নোটিশ জারি করা হয় না। তবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ছাড়া তারেকের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ না করে বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল। অন্যদিকে তারেক ও কায়কোবাদ যে রিভিও আবেদন করেন, তাতে তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়টি সামনে আনেন। এরপর নোটিশটি সরিয়ে নেয় ইন্টারপোল।
বছর ছয়েক আগে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে নোটিশ জারির বিষয়টি নেয় তোলপাড় হলেও সেটি প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে সেভাবে আর আলোচনা হয়নি।
বছর ঘুরে ১৭ বছর আগের সেই বিভীষিকাময় দিনটি আবার এসেছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার যে ঘটনা ঘটেছিল, তার প্রায় দেড় যুগ শেষ হতে চলেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই হামলার পর এর বিচার নিয়ে ঘটেছে নানা ঘটনা। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচারের জট খুলে এক দফা। সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দীনসহ অন্যান্যদের বিচার শুরু হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তদন্ত হয় নতুন করে। আসামি হিসেবে যুক্ত হন তারেক রহমান, কায়কোবাদ, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ আরও অনেকে।
তবে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া ছিল দীর্ঘ। হামলার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে আসে রায়।
গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার চলাকালে বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবির করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৩ মার্চ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। একই বছরের ১২ নভেম্বর কায়কোবাদের বিরুদ্ধেও জারি হয় রেড নোটিশ।
তবে এই দুই জনের পক্ষ থেকে নোটিশটি চ্যালেঞ্জ করা হয়। এই আবেদনের পর যাচাই বাছাই শেষে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নোটিশটি সরিয়ে নেয় ইন্টারপোল। ২০১৮ সালের ৪ মে সরানো হয় কায়কোবাদের নোটিশটিও।
পুলিশ সদর দপ্তরে ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ইন্টারপোলের শাখা হিসেবে কাজ করে। ১৯৪ টা দেশ ইন্টারপোলের সদস্য। ১৯৪টি দেশেই রয়েছে এনসিবি।
পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) এআইজি মহিউল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, আবার যেন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা যায়, সে ব্যাপারে এনসিবির পক্ষ থেকে ইন্টারপোলে দফায় দফায় আবেদন ও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এই দুই জন ছাড়াও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মাওলানা তাজউদ্দিন মিয়া, হানিফ আলহাজ মোহাম্মদ; যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চৌধুরী আব্দুল হারিস ও বাবু রাতুল আহমেদের বিরুদ্ধেও জারি হয়েছিল নোটিশ। তাদেরগুলো এখনও ইন্টারপোলে রয়ে গেছে।
নেতা তারেক রহমান ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হন। পরের বছর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান প্যারোলে মুক্তি নিয়ে। তবে জামিন শেষ হলেও আর ফেরেননি।
গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়াও বিদেশে অর্থপাচারের মামলায় ২০১৬ সালের ২১ জুলাই তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করে হাইকোর্ট। বিচারিক আদালত এই মামলায় তাকে খালাস দিয়েছিল।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড ও দুই কোটি টাকা জরিমানা হয় বিএনপি নেতার। একই মামলায় সাজা হয়েছে তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ারও।
একই বছরের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ আসে।
তার বিরুদ্ধে সবশেষ রায় এসেছে গত ৪ ফেব্রুয়ারি। বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় তার দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছে নড়াইলের একটি আদালতে।
তবে তারেক রহমানের সাজা কার্যকর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে তিনি দেশে না ফেরায়। আর তিনি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন বলে বছর তিনেক আগে গণমাধ্যমে খবর আসে। এরপর কী হয়েছে, সেটি অবশ্য আর জানা যায়নি।
তারেকের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না নোটিশে
যেসব আসামি দেশ থেকে পালিয়ে যায়, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধে বিবেচনায় রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। তবে চার ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে না।
ইন্টারপোলের আর্টিক্যাল-৩ অনুযায়ী এর একটি রাজনীতিবিদ। ২১ আগস্ট মামলার এফআইআর ও পুলিশের অন্যান্য ডকুমেন্টে তারেক রহমানকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। শুধু একজন আসামি হিসেবে তার নাম উল্লেখ করা হয়।
এনসিবির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হলেও পরে তার আইনজীবীরা ইন্টারপোলকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তিনি একজন রাজনীতিবিদ। তাকে রাজনৈতিকভাবে এই মামলায় যুক্ত করে বিচার করা হয়েছে।
এনসিবির একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ইন্টারপোলকে অবহিত করার জন্য যে ফাইলগুলো তৈরি করি, তা পুরো কাজটি উপ-পরিদর্শক ও পরিদর্শক পদের পুলিশ সদস্যরা এতদিন করে আসছিলেন। যে কারণে অনেক বিষয়ে ফাঁক ফোকর থেকে যেত।
‘কিন্তু বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদ দায়িত্ব পাওয়ার পর এই পেপার ওয়ার্কগুলো ল ফার্ম দিয়ে করানো হচ্ছে। এতে করে ইন্টারপোলের সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বেশি রেসপন্স পাচ্ছি।’
রেড নোটিশ দিলেই কী আসামি ফেরত পাওয়া যায়?
দেশের বাইরে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হলেই তাদের ফিরিয়ে আনা যায় না। এর জন্য আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের সঙ্গে চুক্তি থাকতে হয়।
এনসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, রেড নোটিশ জরি করেছে ইন্টারপোল আর ইন্টারপোলের মাধ্যমেই আমরা আসামি ফিরিয়ে আনব। এটা আসলে পসিবল না। রেড নোটিশ ইন্টারন্যাশনাল ওয়ারেন্ট না। রেড নোটিশ জারি হলেই ওই দেশ আমাকে আসামি দিয়ে দেবে বিষয়টা এমন না।’
তিনি বলেন, ‘যেমন কানাডাতে আমাদের নূর চৌধুরী (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া) আছে। ওকে আমরা আনতে পারছি না। কারণ, কানাডার আইনে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (মৃত্যুদণ্ড) এলাও করে না। আর্টিক্যাল-২ তে বলা হয়েছে, ইন্টারপোল উইল কো-অপারেট। কিন্তু আসামি হস্তান্তর করবে কিনা তা নির্ভর করে ওই দেশের আইনের ওপর।’
তাহলে রেড নোটিশ করে লাভ কী?
এনসিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘পলাতক আসামিকে বিদেশ থেকে ফেরানোর জন্য রেড নোটিশ করাই লাগবে। একটা আসামিকে দেশে আনতে হলে যে প্রক্রিয়া শুরু করা লাগে, সেজন্য এটা লাগবেই। এক্সট্রাডিশন (প্রত্যার্পন), এক্টার্ডিশন চুক্তি আছে কি না, ডিপোর্টেশনের মাধ্যমে আনব কি না। এই জিনিসটা শুরু করতে হলে রেড নোটিশ জারি করা লাগবে। রেড নোটিশ জারি না করলে কোনো দেশ আপনার কথা শুনবে না। রেড নোটিশ করার পর ইউ ক্যান মেইক এ রিকোয়েস্ট টু আদার কান্ট্রি অর টু দ্যা আদার এনসিবি।’
তিনি বলেন,‘এই এক্সট্রাডিশন অ্যান্ড ডিপোটেশনের পার্টটা ইনিশিয়েট করতে হয় ফরেন মিনিস্ট্রির মাধ্যমে। নূরকে আনার ক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ফরেন মিনিস্ট্রিকে মুভ করতে হয়।’
মাত্র দুটি দেশের সঙ্গে এক্সট্রাডিশন চুক্তি আছে। বাকিদের সঙ্গে নেই। এই দুই দেশ হল ভারত ও থাইল্যান্ড।
ইন্টারপোলের বাকি ১৯২ টি দেশ থেকে পলাতক আসামি ফিরিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট ওই দেশের একটা চুক্তি করতে হয়, যা হলো মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্ট ট্রিটি। এটা করে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কাউকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই চুক্তির পর বাকি কাজগুলো মন্ত্রণালয়ই করে থাকে বলে জানান এনসিবির এই কর্মকর্তা।