জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে সরকার মিথ্যাচার করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে জনগণ এ ধরনের মিথ্যাচার বিশ্বাস করবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
বুধবার বিকেলে ‘ইতিহাস কথা কয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা আয়োজন করে বিএনপি। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে বক্তব্য দেয়ার সময় এসব মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ একটি তাবেদার রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের সরকার একটা পতুল সরকার। তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার জনগন বিচ্ছিন্ন। এ কারণে তারা মিথ্যা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিহিংসার এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস প্রতিষ্ঠার বহুমুখী প্রচারণা চালাচ্ছে। বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলার শিকারে পরিণত করা হচ্ছে।
‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে মিথ্যা কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কারণ জিয়াউর রহমান সাহেব শুধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দেননি, তিনি পরবর্তীকালে যখন দায়িত্ব পেয়েছেন তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।’
পঁচাত্তরের ঘটনায় সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেয়া বক্তব্যকে ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার’ বলে নিন্দা জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর বক্তব্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রায়কেও অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অপরাধমূলক ঘটনা।
‘এ ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে এজাহার দায়ের করে তার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষী-সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে বিচারকাজ শেষ হয়েছে। ওই বিচার প্রক্রিয়ার পর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ‘পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজ চাপ্টার’কে পুনরায় বির্তকের বিষয় হিসেবে তুলে এনে আইনমন্ত্রী জ্ঞানপাপীর পরিচয় দিচ্ছেন।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তার এ ধরনের বক্তব্য থেকে প্রশ্ন জাগে, ওই বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে জড়িত থেকে আওয়ামী লীগের ভাষায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পর এ ধরনের বক্তব্য কেন দিচ্ছেন? এ ধরনের বক্তব্য কি ক্রিমিনাল এক্সিকিউশনের পর্যায়ে পড়ে না?’
আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট আসলে নিজেদের তৈরি কথা জনগণকে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে। সেখানেই আমাদের প্রতিবাদ, সেখানে আমাদের সত্য কথা বলার প্রয়োজনীয়তা। সত্য যদি প্রকাশিত হয় তাহলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির অস্তিত্ব থাকে না।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সেনাবাহিনীর ৪৬তম বিগ্রেডে কর্মরত বিগ্রেড মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন বলেন, “ওই ঘটনার দিন ভোরে বিগ্রেড কমান্ডার কর্ণেল সাফায়েত জামিলসহ আমি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে দেখা করি। তাকে কর্ণেল সাফায়েত বললেন, ‘স্যার প্রেসিডেন্ট হ্যাড বিন কিল্ড।’
“জেনারেল জিয়াউর রহমানের রিঅ্যাকশন দেখেন, সাচ আ সোলজার। তিনি বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট নাই তো কী হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে। আমরা সৈনিক লেট আস আপহোল্ড দি কনস্টিটিউশন, আমরা সংবিধানকে সম্মুন্নত রাখব। গো অ্যান্ড গেট ইউ ট্রুপস রেডি।”
মেজর (অব.) হাফিজ বলেন, ‘তিন বছর আগে সাফায়েত জামিল মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি একটি বই লিখেছেন, সেখানে এই ঘটনার বিবরণ দেয়া আছে। অবসরপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে কর্ণেল সাফায়েত জামিল কোনো রাজনীতিতে জড়াননি, কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল। এরপরও তিনি ১৫ আগস্ট সকালের সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি। আমার বইতেও এই বিবরণ আছে। আমরা চাক্ষুষ সাক্ষী সেদিন তিনি (জিয়া) কী বলেছেন সেদিন।’
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক ছিলেন, যিনি সংবিধান সম্মুন্নত রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আমাদেরকে বলেছিলেন, গো অ্যান্ড গেট ট্রুপস রেডি। তাদের নেতাকে (শেখ মুজিবুর রহমান) মহান নেতা বলে সম্বোধন করেছিলেন।
‘জীবনে কোনো দিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কখনও আওয়ামী লীগের নেতা বা তাদের যারা শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো কটূক্তি করেন নাই। এ ধরনের একজন সাদা মনের মানুষকে আজকে তারা খুনি হিসেবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে চায়।’
হাফিজ বলেন, ‘আমি বলব, এখনও সময় আছে শিক্ষা নেয়ার। আফগানিস্তানে কী হয়েছে- এটা থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেন। অনেককে কিন্তু হেলিকপ্টারের ডানা ধরে ঝুলতে হবে। আফগানিস্তান থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারছি যে, জনগণের জয় একদিন না একদিন হবেই।
‘দেশের অধিকাংশ জনগণ যাকে সমর্থন করবে, যে দল বা যে আদর্শকে সমর্থন করবে এটিকে কোনোদিন দাবিয়ে রাখা যায় না। যার জন্যে পৃথিবীর সবচেয়ে সর্বশক্তিমান পরাশক্তিকেও আফগানিস্তান থেকে যেতে হয়েছে।’
মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ অনেকে।