দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘নতুন জাতীয় পার্টি’ গঠনের আওয়াজ দিয়ে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই বিদ্রোহীদের। দলটির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস দিয়ে তারা এখন চুপ।
এই অংশটির পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চলছে। তবে ঘোষণার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দলের কোনো নেতাকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়নি। দলের নেতৃত্ব সংশয়হীনভাবে বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের হাতেই রয়েছে বলে দলটির নেতারা বলছেন। ‘নতুন নেতৃত্বের ঘোষণার’ পেছনে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকীর হাত আছে বলে তারা মনে করছেন।
গত ১৪ জুলাই এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্কে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে দলের ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন এরশাদ-বিদিশার ছেলে এরিক এরশাদ। সেখানে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ও বিদিশা সিদ্দিকীকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরিক।
ওই অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন না। এ ঘোষণার ব্যাপারেও তার পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।
দিনভর নাটকীয়তার পর সেদিন রাতে জি এম কাদেরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সন্ধ্যায় তার সঙ্গে রওশন এরশাদের ফোনে আলাপ হয়েছে। তিনি জি এম কাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন।
'নতুন নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি' গঠন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিদিশা এরশাদ। ফাইল ছবি
ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন এরশাদ-রওশনের ছেলে ও জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাহগীর আল মাহি সাদ। অনুষ্ঠানে তিনি তার অসুস্থ মায়ের জন্য দোয়া করতে অনুরোধ করেন।
নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। দলীয় কর্মকাণ্ডে তিনি তেমন সক্রিয়ও নন।
অনুষ্ঠানে দলকে উজ্জীবিত করতে দুই ছেলের সঙ্গে সারা দেশ সফর করার পরিকল্পনার কথা সে দিন জানান বিদিশা। বলেন, ‘আমার দুই সন্তান সাদ ও এরিককে নিয়ে আমি সারা বাংলাদেশে ঘুরে এরশাদ সাহেবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। দুই সন্তানকে পাশে নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বার্তা দেব, এরশাদ সাহেব কী করেছেন। বাংলাদেশের জন্য ওনার কী অবদান, সেটা মনে করিয়ে দেব।’
জি এম কাদেরের অবস্থান সংহত
সে দিনের ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন সাদ এরশাদ। জাতীয় পার্টি সংশয়হীনভাবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই রয়েছে বলে তিনি জানান।
নিউজবাংলাকে সাদ এরশাদ বলেন, ‘আমি ওই দিন উপস্থিত ছিলাম ঠিকই। ওই বিষয়ের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত নই। আর কার মাথায় কী পরিকল্পনা রয়েছে, এ বিষয়টি তো আমি জানি না। আমাকে ইনফর্ম করে কোনো কিছু বলা হয়নি। জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব এখন জি এম কাদেরের হাতে। এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।’
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ এরশাদ। সঙ্গে আছেন বিদিশা এরশাদ ও এরিক এরশাদ। ছবি: নিউজবাংলা
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলে তিন বছরের জন্য দলের চেয়ারম্যান হন তার ছোট ভাই জি এম কাদের।
ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি: বিদিশা
‘দলের নতুন নেতৃত্বের’ ঘোষণার বিষয়ে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সংগঠিত হতে সময় লাগে। আমরা জেলায় জেলায় সংগঠিত করছি। সারা বাংলাদেশেই আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।
সে দিন এরিক দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে নাম ঘোষণা করেন কাজী মামুনুর রশীদের, যিনি এরশাদ ট্রাস্ট্রের সভাপতি। এ ব্যাপারে গত রোববার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দলের কার্যক্রম চলছে। লকডাউনের কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম করা যাচ্ছে না। লকডাউন যাক, তারপর জানতে পারবেন।’
দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ উদ্যোগের কোনো স্বীকৃতি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপেক্ষা করেন, দেখেন নেতা-কর্মীরা কার সাথে থাকে।’
যাকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে, তিনি এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দেননি, জানানো হলে কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘উনি সরাসরি কী অপিনিয়ন দেন, দেখেন।
তিনি জি এম কাদেরকেই দলের নেতৃত্বে দেখতে চেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হলে কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘উনি তো সাংবাদিকদের কিছু বলেননি। অপেক্ষা করেন, দেখেন।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে দলকে সুসংগঠিত করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। দলকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উদ্দেশ্য।’
কার নেতৃত্বে তা করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি কোনো দিন ক্ষমতায় যাবে না।
ভাঙনের শঙ্কা নেই
জাতীয় পার্টিতে নতুন নেতৃত্বের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন দলটির নেতারা। বিদিশার উদ্যোগকে ‘স্টান্টবাজি’ বলছেন তারা।
শীর্ষ নেতারা বলছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর ভাঙনের কবলে পড়ে জাতীয় পার্টি। সে সময় জি এম কাদেরপন্থি ও রওশন এরশাদপন্থি এই দুই ভাগে স্পষ্ট বিভক্ত হয়ে যায় দল। এ বিরোধ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন বিদিশা। তিনি দলের সাবেক কয়েকজন নেতার মাধ্যমে দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জি এম কাদেরের শক্ত অবস্থানের কারণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এক, অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ। কে, কী বলল, এতে আমাদের যায় আসে না। আমাদের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই।’
বিদিশার দিকে ইঙ্গিত করে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘যে জাতীয় পার্টির লোক না, কিছু না, তার কথায় একটি ছোট বাচ্চা কী বললো, একে গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে?’
তিনি বলেন, ‘তারা (বিদিশার অংশ) যাদের নাম বলছে, তারা তো এখনও আমাদের সঙ্গেই আছে। তারা উল্টা আমাদের পক্ষে অবস্থানের কথা তুলে ধরেছে। ওই ঘটনা সে দিনই শেষ হয়ে গেছে।’
তবে ‘নতুন নেতৃত্বের’ ঘোষণা নিয়ে দলের রওশনপন্থি নেতারা বলছেন, এ ঘটনার সঙ্গে রওশন এরশাদ সম্পৃক্ত নন।
‘নতুন নেতৃত্ব ঘোষণার’ পর পর জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার জানামতে আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদ এতে কোনোভাবেই যুক্ত নন। উনি আমার মায়ের মতো। উনি যদি কোনো কিছু করতেন, তাহলে একটিবারের জন্য হলেও আমার সঙ্গে কথা বলতেন।’