রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিন দেখা নেই রাজনৈতিক জোট ১৪ দলের। করোনা শুরুর পর থেকে মাঠে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মকাণ্ড নেই। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো নানা মানবিক কার্যক্রম চালালেও কোথাও নেই ১৪ দল। কদাচিৎ তাদের দেখা মেলে কোনো জুম আলোচনায়।
১৪ দলের শরিক দলগুলোর অভিযোগ, সবচেয়ে বড় শরিক আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তার কারণে ১৪ দল সক্রিয়তা হারিয়েছে। অনেকের মতে, ১৪ দলের কোনো কার্যকারিতা এখন আর নেই। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করছে জোটের সবচেয়ে বড় শরিক আওয়ামী লীগ।
বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে ২০০৪ সালে গঠিত হয় রাজনৈতিক জোট ১৪ দল। সে সময় থেকে জোটের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে আসছিলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা মোহাম্মদ নাসিম। তার মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব পান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু।
গঠনের সময় এই জোটের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা।
মূলত তিনটি বিষয় সামনে রেখে গঠিত হয় ১৪ দল। এগুলো হলো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান; উন্নয়নমূলক কাজের ভিশন এবং সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান।
১৪ দলে আওয়ামী লীগ ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি)।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় নিয়ে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট মহাজোট। এ সময় ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনেও দেখা গেছে এ ধারা। এই দুই মেয়াদে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বিভিন্ন সময় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত মুজিববর্ষের এক অনুষ্ঠানে ১৪ দলের নেতারা। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মন্ত্রিসভায় শরিকদের রাখেনি দলটি। বর্তমানে সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন ১৭৫ জন। শরিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটির ৭ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬ জন, তরীকত ফেডারেশনের ২ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ২ জন এবং বিএনএফের ১ জন সংসদ সদস্য।
মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ায় ১৪ দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষনেতা প্রকাশ্যেই আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর হন। এতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের অন্যান্য শরিক দলের মনোমালিন্য প্রকাশ্যে আসে, দৃশ্যমান হয় নানা মতবিরোধও।
তার ওপর ১৪ দলে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যেও নানা কারণে ভাঙন দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আলাদা দল গঠন করে।
আবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ভেঙেও বাংলাদেশ জাসদ নামে আলাদা দল গঠন হয়েছে। সাম্যবাদী দল ও গণ-আজাদী লীগেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। দুই টুকরা হয়েছে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনও। অর্থাৎ শক্তি কমেছে শরিক দলগুলোর।
দেশে গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে একযোগে খুব একটা কর্মসূচিও পালন করতে দেখা যায়নি ১৪ দলকে। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতেও একপ্রকার নিষ্ক্রিয় এ জোট। মাঝেমধ্যে অনলাইনে দু-একটি আলোচনা সভা করা হলেও জোটের মধ্যে আগের মতো সেই মিল আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনকি গত বছরের ডিসেম্বরে যাত্রাবাড়ীর সড়কদ্বীপে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বসানো নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও ১৪ দলের পক্ষ থেকে তখন কোনো সমন্বিত কর্মসূচি দেখা যায়নি।
১৪ দলের অন্যতম শরিক দলগুলো এ নিষ্ক্রিয়তার দায় ঠেলছে আওয়ামী লীগের দিকে। তাদের দাবি, বড় শরিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয়তা ১৪ দলের জন্য ভালো নয়।
জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৪ দলের শরিক দলগুলো ভেতরে বিভিন্ন রাজনৈতিক লেনদেন নিয়ে সমস্যা আছে। এ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই আছে। সেটা আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কখনও সমাধান হয়, কখনোবা ঝুলে থাকে। সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগ ১৪ দলে কিছুটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। এটা ১৪ দলের ভেতরে অসন্তোষ তৈরি করেছে।
‘১৪ দলকে সক্রিয় রাখতে হলে বড় শরিক আওয়ামী লীগের একটি বড় ভূমিকা থাকা দরকার। বর্তমানে যে সমস্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চলছে, করোনাভাইরাস, দুর্নীতির ভাইরাস আর জঙ্গি ভাইরাস- এই তিন ভাইরাস মোকাবিলা করতে হলে ১৪ দলের আরও সক্রিয় ভূমিকা সর্বস্তরে দরকার। সে হিসেবে আওয়ামী লীগ তার উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা, শিথিল ভাব পরিহার করলে আর সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তা দেশের জন্য মঙ্গলের, সরকারের জন্য মঙ্গলের।’
১৪ দলের অন্যতম নেতা এবং বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া মনে করছেন, গত নির্বাচনের পর ১৪ দল তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। তার মতে, ১৪ দল এখন অতীত।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৪ দলের তো কার্যকারিতাই নেই। এটা যদিও আমার ব্যক্তিগত মত। যদিও অতীতে ১৪ দলের অনেক অবদানই আছে। কিন্তু গত নির্বাচনের পর থেকে এটা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। আমার সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত হবেন না। প্রতিটি দল যার যার মতো কাজ করছে।
‘এখনকার সরকার হলো আওয়ামী লীগের। ১৪ দলের সরকার নেই। সরকারের আমলে যা হচ্ছে, কোনো শৃঙ্খলা নেই, ন্যায়নীতি নেই বা সরকারের নৈতিক ভিত্তিও অনেক দুর্বল। এর ফলে অনেক জায়গায় অনেক বিশৃঙ্খলা আছে। চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট, লুণ্ঠন- এগুলো থেকে দেশের মানুষকে মুক্ত করা এবং দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা- এগুলো কিছু হচ্ছে। ডেভেলপমেন্ট কিছু হচ্ছে, কিন্তু এটা হচ্ছে দুর্নীতির বিনিময়ে।’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকার অনেকটা উপেক্ষা করছে বা নজর দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগও নানাভাবে বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে গেছে। আমার বিবেচনায় গত নির্বাচনের পর সরকারের নৈতিক ভিত্তি এত দুর্বল হয়েছে যে, কোনো জায়গায় নীতিনৈতিকতার বালাই নেই।
‘১৪ দলের কোনো ফাংশনও নাই, এখন কি ১৪ দল সরকারের বিরুদ্ধে মুভমেন্ট করবে? কাজেই ১৪ দল এখন অতীত’, যোগ করেন তিনি।
১৪ দলের অন্যতম নেতা ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস অবশ্য নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। হাসানুল হক ইনুর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইনু ভাই আমাদের ১৪ দলের একটি শরিক দলের সভাপতি। সে হিসেবে তিনি কী মন্তব্য করেছেন, সেটি না দেখে বা না জেনে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
১৪ দলের কার্যক্রম কেমন চলছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রুটিনে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দিবসে আমরা আলোচনাগুলো করি।
‘আমার জানামতে, ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়কের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। বিভিন্ন বিষয়েই তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয় বা মতবিনিময় হয়।’