ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরলেন প্রবীণ সিপিবি নেতা মনজুরুল আহসান খান। করোনাকালে রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলেও দলীয় কৌশল প্রণয়নে যুক্ত হচ্ছেন উপদেষ্টা পরিষদের এই নেতা।
সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে গত ডিসেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিকে কলাম লেখার কারণে দলে বিরাগভাজন হন তিনি। পরে ৫ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে তার সদস্যপদ স্থগিত করা হয় ছয় মাসের জন্য।
স্থগিতাদেশের মেয়াদ এরই মধ্যে ছয় মাস শেষ হয়ে গেছে। তবে এই সময়ে আবার চলাচলে বিধিনিষেধ দিয়ে জারি করা হয়েছে আদেশ। অকারণে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ, জমায়েত তো বটেই। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে, অফিসগুলোও বন্ধ।
ফলে মনজুরুল তো বটেই, পুরানা পল্টনের দলীয় কার্যালয়ে যাচ্ছেন না অন্য নেতারাও। যোগাযোগ যা হচ্ছে, তার প্রায় সবই অনলাইনে।
তবে গত ৮ জুলাই মনজুরুলকে দলে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি তাকে জানানো হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন।
তিনি বলেন, ‘গত ৮ জুলাই এই স্থগিতের মেয়াদ শেষ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তিনি আগের পদে বহাল হয়েছেন। এরপর আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’
দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডে তিনি অংশ নিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে ক্বাফী বলেন, ‘করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতির কারণে আপাতত এই কয়েক দিনের মধ্যে কর্মসূচি পড়েনি। আর তার শারীরিক অবস্থাও এই মুহূর্তে একটু খারাপ।’
দলে ফিরলেও করোনাকালে দলের প্রকাশ্য কর্মসূচি নেই বলে মনজুরুলের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি
নিউজবাংলাকে মনজুরুল বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমাকে গত ৮ জুলাই জানানো হয়েছে। আমি দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছি।’
এই কয়েকদিনে আপনার ভূমিকা কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাকে দলীয় কিছু ডকুমেন্ট দেয়া হয়েছে। এগুলো পড়ছি। আপাতত তো বাইরে কোনো কর্মসূচি নেই।’
স্থগিতাদেশ উঠা নিয়ে কোনো বার্তা দেবেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি সারা জীবন মানুষের জন্য, সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। কোনো সময় যদি দলীয় পদ নাও থাকে, তাও আমি আমার কার্যক্রম চালিয়ে যাব।’
তিনি এও বলেন, ‘আমি তো সব সময় দলের সিদ্ধান্ত মেনেই চলি। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।’
মনজুরুল যা লিখেছিলেন
গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় মনজুরুল আহসান খানের নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ হয়। এতে পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা রাজনৈতিক ঘটনা তুলে ধরে শেষ দিকে দেশের উন্নয়নের কথা বলা হয়।
মনজুরুল লেখেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যমুনা সেতু ও পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। দেশ ক্রমেই উন্নত দেশের পর্যায়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।’
- আরও পড়ুন: অবশ্যই হাসিনার সাফল্য আছে: মনজুরুল
এই লেখাটি মনজুরুল দিয়েছিলেন কানাডার নাগরিক পত্রিকায়। পরে তার অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিন।
এরপর সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার সম্পর্কে মনজুরুলের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন সিপিবির মূল্যায়ন নয়।
সিপিবির অভিযোগ, একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এ জন্য তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বানও জানান হয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
বছর কয়েক আগে সিপিবির আরও একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা হয়। সে সময় দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ফেসবুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে দলের সমালোচনা করা যাবে না।
এরপর নিউজবাংলাকে দেয়া সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘হাসিনার তো অবশ্যই সাফল্য আছে। পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, দরিদ্র মানুষকে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু করা, এটা তার বিরাট কৃতিত্ব।’
সিপিবির কোনো কোনো নেতা সরকারকে ফ্যাসিস্ট মনে করেন জানিয়ে তার সঙ্গেও একমত নন বলে জানিয়েছেন মনজুরুল।
তিনি বলেন, ‘আমি বলি যে, সরকারের এই কর্মকাণ্ডে ফ্যাসিজম বলা ঠিক হবে না।
‘বামপন্থিদের অনেকেই, এমনকি আমাদের পার্টির মধ্যে অনেকেই ফ্যাসিজম বলে অভিহিত করতে চায়। কিন্তু ফ্যাসিজমের তো একটা সংজ্ঞা আছে। আমি বলতে পারি বর্তমান সরকারের মধ্যে স্বৈরাচারী প্রবণতা তৈরি হয়েছে।’
সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে পত্রিকায় যা লিখেছিলেন, সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজকে দেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক হতে হবে। যারা নানানভাবে দেশি-বিদেশি মদদ নিয়ে দেশের ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে আমাদেরকে সতর্ক থাকার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি।’
দলের মধ্যেও বিভক্তি
মনজুরুলের বিরুদ্ধে ওই ব্যবস্থা নেয়ায় সিপিবিতে সে সময় বিভক্তিও তৈরি হয়।
অনেকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সিদ্ধান্তকে মানতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে অনলাইনে সিপিবির হয়ে লেখালেখি করেন এমন একজন বলেন, ‘দুই পক্ষই ছেলেমি করছে।’
মনজুরুল সরকারের যে উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করেছেন, নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে সিপিবির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স তার কয়েকটির কথা উল্লেখ করে একে ভালো কাজ বলেছেন।
- আরও পড়ুন: মনজুরুল নিয়ে সিদ্ধান্তে সিপিবিতে বিভেদ
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু ভালো হয়েছে। এটা পার্টি থেকেই বলছি আমরা। এই সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, অবশ্যই পজিটিভ কাজ। তিনি (মনজুরুল) তো এ কথাই বলছেন, যেখানে কোনো দ্বিমত নেই। তিনি যা বলেছেন ভুল বলেননি।’
তাহলে মনজুরুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন?
সে সময় প্রিন্স বলেন, ‘সেটা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে দৃশ্যমান হবে। এটাই হচ্ছে সমস্যা। এই লেখাটার বিষয়ে আমাদের পার্টির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মেলে না।’