জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে নাটকীয়ভাবে দলটিতে ব্যাপক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি বলছে, আরেক দফা ভাঙতে যাচ্ছে দলটি।
এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীর বারিধারা প্রেসিডেন্ট পার্কে বুধবার বেলা ১১টায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আলোচনা সভারও আয়োজন করে এরশাদ ট্রাস্ট।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এরশাদের বড় ছেলে ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ এরশাদ এবং ছোট ছেলে এরিক এরশাদ ও তার মা বিদিশা এরশাদ।
আলোচনা সভায় দলের নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলেন এরিক এরশাদ। সমালোচনা করেন চাচা জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের।
উপস্থিত নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে এরিক বলেন, ‘আমার আব্বা এরশাদ সাহেব যখন জীবিত ছিলেন, তখন রাতের অন্ধকারে আমাকে ডেকে নেন চাচা জি এম কাদের। তিনি আমাকে দিয়ে সই করিয়ে অবৈধভাবে দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। তার কাছ থেকে দলকে বাঁচাতে হবে।’
এ কথা বলার পরই জাতীয় পার্টির নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করেন এরিক। বলেন, ‘আমি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আমার মা রওশন এরশাদকে, কো-চেয়ারম্যান হিসেবে আরেক মা বিদিশা এরশাদ ও ভাই রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদের নাম ঘোষণা করছি।’
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদের নাম ঘোষণা করেন এরিক।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্টের ওই মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভার শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল প্রবল নাটকীয় কিছু ঘটতে চলছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির কয়েকজন সাবেক নেতা ছাড়াও এরশাদ ট্রাস্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন এরশাদ জীবিত থাকা অবস্থায় প্রস্তাবিত ৫৮ দলীয় জোটের কয়েকজন নেতা। অনুষ্ঠানে তাদের অনেকেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সমালোচনা করেন।
আলোচনা সভায় বেশ সরব ছিলেন বিদিশা। তিনি জানান, এখন থেকে এরিকের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই দল পরিচালিত হবে। অনুষ্ঠানে বিদিশাকে বেশ চঞ্চল দেখা গেছে। অনুষ্ঠান শেষে শুভানুধ্যায়ীদের দেয়া ফুলও গ্রহণ করেন তিনি।
দলকে উজ্জীবিত করতে দুই ছেলের সঙ্গে সারা দেশ সফর করার পরিকল্পনার কথাও জানান বিদিশা। বলেন, ‘আমার দুই সন্তান সাদ ও এরিককে নিয়ে আমি সারা বাংলাদেশে ঘুরে এরশাদ সাহেবের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করব। আমাদের কেউ থামাতে পারবে না। দুই সন্তানকে পাশে নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে বার্তা দেব, এরশাদ সাহেব কী করেছেন, বাংলাদেশের জন্য ওনার কী অবদান, সেটা মনে করিয়ে দেব।’
এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠানেই যোগ দেননি রওশন এরশাদ।
এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ এরশাদ। সঙ্গে আছেন বিদিশা ও এরিক এরশাদ। ছবি: নিউজবাংলা
বুধবার প্রেসিডেন্ট পার্কের প্রস্তাবিত কমিটি প্রসঙ্গে রওশন এরশাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এর আগেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে তার একান্ত সচিব মামুন হাসানও নিউজবাংলাকে কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘উনি (রওশন) ওনার বাসাতেই রয়েছেন।’
এরশাদ ট্রাস্ট আয়োজিত আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন এরশাদ ও রওশন এরশাদের ছেলে রাহগির আলমাহি সাদ এরশাদ।
তিনি বলেন, ‘আমার মা বেগম রওশন এরশাদ। উনি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ওনার বয়স হয়েছে, আজকে উনি আসতে পারেননি। আপনারা ওনার জন্য দোয়া করবেন।’
দল পরিচালনায় এরিকের প্রস্তাবের বিষয়ে অবশ্য মন্তব্য করতে রাজি হননি সাদ এরশাদ। শুধু বলেছেন, ‘এইটুকু বলতে পারি, হিংসার রাজনীতি আমি পছন্দ করি না।’
এদিকে বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিদিশাকে দলের কো-চেয়ারম্যান করার যে প্রস্তাব এরিক করছেন, সে ব্যাপারে তেমন কিছুই বলেননি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
বুধবার দুপুরে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কাকরাইলের জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বরে দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ শেষে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, ‘কমিটি নিয়ে আমরা কিছু জানি না। এ ব্যাপারে আমরা কিছু বলতেও চাই না। দল গঠন যে কেউ করতে পারে। তবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাগবে।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদের ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের চেয়ারম্যান হন তার ছোট ভাই জি এম কাদের।
এরিক এরশাদ ঘোষিত জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকে আমরা নেতৃত্ব ঘোষণা করেছি। এখন সবকিছুতে তো সময় লাগে। যেকোনো সংগঠন গোছাতে সময় লাগে। খুব তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে অনেক কিছু দৃশ্যমান হবে। অপেক্ষা করেন, দেখেন, সময় লাগবে।’
জি এম কাদেরের নেতৃত্ব নিয়ে তিনি বলেন, ‘ওনার নেতৃত্বে কোনো কিছু নেই। এটা এরশাদের দল। এরশাদের পরিবার এটা করছে। দল কোনো দিন ব্যক্তির হয় না।’
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার জানামতে আমাদের নেত্রী রওশন এরশাদ এতে কোনোভাবেই যুক্ত নন। উনি আমার মায়ের মতো। উনি যদি কোনো কিছু করতেন, তাহলে একটিবারের জন্য হলেও আমার সঙ্গে কথা বলতেন।’
এরিক এরশাদের নতুন নেতৃত্ব প্রস্তাব প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বেগম রওশন এরশাদ আমাদের দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, উনি সম্মানী মানুষ। উনি আমাদের চেয়ারম্যানকে (জি এম কাদের) দুপুরে ফোন করে কথা বলছেন। উনি বলছেন, শেষ জীবনে আমি মানুষ হাসাতে চাই না। আমি ওদের সঙ্গে যুক্ত না, তুমি কাজ করে যাও। আমি তোমার সঙ্গে আছি।’
এরিক এরশাদের ঘোষণার কোনো গুরুত্ব নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন দাঁড়িয়ে বলে দিলে তো আর হবে না। রাজনৈতিক দল হওয়ার তো কিছু আইনকানুন আছে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হলো জাতীয় পার্টি। এই দলে নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে হলে পরবর্তী কাউন্সিলের মাধ্যমে করতে হবে।’
এদিকে, জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী নন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারী খন্দকার দেলোয়ার জালালী এমন তথ্য জানিয়েছেন।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জালালী জানান, বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। জি এম কাদের নেতৃত্বে দল সঠিক ভাবে চলছে বলেও তিনি মনে করেন। সেই সঙ্গে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হিসেবে তার সাফল্য কামনা করেছেন। জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও বেগম রওশন এরশাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।