তারেক রহমানকে নিয়ে কথা বললে ‘কিছু হয়ে গেলে আমরা দায়ী থাকব না’ বলে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রদল। বরং সংগঠনের নেতারা মনে করেন, ওমর ফারুক কাউসার সেদিন ‘সঠিক কাজ করেছেন’।
ছাত্রদল নেতারা এও বলেছেন, ভবিষ্যতেও বিএনপি বা দলের নেতাদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে একইভাবে ‘প্রতিবাদ করে যাবেন’ তারা।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে যে আলোচনায় বিএনপি সমর্থক এই বুদ্ধিজীবীকে ‘হুমকি’ দেয়া হয়, সেখানে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এহছানুল হক মিলন। তিনিও সেদিন ছাত্রদল নেতাকে কিছু বলেননি।
এ বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর আলোড়ন তুললেও বিএনপির কোনো নেতা জাফরুল্লাহকে ফোন করে তার খোঁজখবর নেননি। যদিও জাফরুল্লাহ গত কয়েক বছর ধরেই বিএনপির পক্ষ নিয়ে কথা বলে আসছেন।
গত শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে বক্তব্য রাখছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিএনপির কী করা উচিত তা বলতে গিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী তারেক রহমানকে দুই বছর চুপচাপ থেকে পড়ালেখা করার পরামর্শ দেন। আর তিনি এও বলেন যে, ‘বিএনপি চলে লন্ডন থেকে আসা ওহি দিয়ে।’
এ কথা বলার পর পর শ্রোতার আসনে থাকা ছাত্রদলের সহসভাপতি ওমর ফারুক কাউসার দাঁড়িয়ে ‘স্লামালাইকুম ওস্তাদ’ বলে কটাক্ষকর সম্বোধন করেন জাফরুল্লাহকে।
সবাই চমকে গিয়ে কাউসারের দিকে দৃষ্টি দেন। আর তিনি জাফরুল্লাহর সঙ্গে তর্ক করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেন, ‘আপনি বিএনপির কে যে আপনার কথা শুনতে হবে?’
পরে বলেন, ‘আপনি আমাদের নেতাকে নিয়ে কথা বলবেন না। যদি বলেন, পরবর্তী সময়ে কিছু হলে কিন্তু আমরা দায়ী না।’
জাফরুল্লাহ চীনপন্থি বাম বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত হলেও গত এক দশক ধরে বিএনপিকে নানা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আসছেন। বিএনপি এসব পরামর্শ নিচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তিনি তার সিংহভাগ আলোচনায় বিএনপির কী করা উচিত, তা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। বিএনপিকে ক্ষমতায় আসতে দ্রুত আন্দোলনে যাওয়ার তাগিদও দিয়ে আসছেন তিনি। একাধিকবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে খোলা চিঠিও লিখেছেন তিনি।
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনেও জাফরুল্লাহ রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নিজেও যোগ দেন সেই জোটে।
স্বভাবতই তাকে এভাবে প্রকাশ্য ‘হুমকি’ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে যিনি ‘হুমকি’ দিয়েছেন, তার সংগঠন ছাত্রদল এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
জাফরুল্লার কাছে এমন আচরণ আশা করে না ছাত্রদল
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ব্যবহার করতেন, সেটিতেও পাওয়া যায়নি।
পরে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন নিউজবাংলার সঙ্গে। তিনি কাউসারকে সমর্থনই করেন। তিনি মনে করেন না জাফরুল্লাহকে হুমকি দেয়া হয়েছে।
কাউসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না, জানতে চাইলে শ্যামল বলেন, ‘ব্যবস্থা নেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমরা বিষয়টি দেখেছি। কাউসারের কথায় কোনো উগ্রবাদী আচরণ ছিল না। উল্টো সে খুব বিনয়ের সঙ্গে সালাম দিয়ে কথা বলেছে।’
ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন সিনিয়র সিটিজেন। মুক্তিযুদ্ধে ওনার একটি ভূমিকা রয়েছে। একই সঙ্গে তারেক জিয়া এই মুহূর্তে আমাদের সাংগঠনিক অভিভাবক। দলকে নিয়ে, অভিভাবককে নিয়ে কথা তোলায় নিজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে সে (কাউসার) তার কথা বলেছে মাত্র। প্রতিবাদ করেছে। এ ধরনের প্রতিবাদকে আমরা সমর্থন করি। ভবিষ্যতে ঘটলেও আমরা তাই করব। একই সঙ্গে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো একজন বুজুর্গ ব্যক্তির থেকে এ রকম আচরণ আমরা আশা করি না।’
কাউসার যা বলছেন
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয়েছে কাউসারেরও। তিনি বলেন, ‘জনাব তারেক জিয়া আমাদের অভিভাবক। এই দল আমাদের আদর্শ। উনি সব সময় এমন সমালোচনা করে যান। আগেও অনেকবার নানা আপত্তিকর কথা বলে আসছেন। আমরাও রক্ত-মাংসের মানুষ।’
সেদিন তার বক্তব্যে আক্রমণাত্মক কিছু ছিল না বলেও মনে করেন এই ছাত্রদল নেতা। বলেন, ‘উনাকে হুমকি দিইনি। আমি সালাম দিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে তাকে বলেছি। খারাপ লাগার জায়গা থেকে ওনাকে সতর্ক করেছি মাত্র।’
কারা কিছু করবে বলে আশঙ্কা করছেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা ভিন্নমতে বিশ্বাসী। উনি ওনারটা বলবেন। তবে এই যে উনি যে উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন। আমাদের ছাত্রদলেই কত ছেলে আছে। সবার কন্ট্রোল একরকম না। দলকে নিয়ে, প্রিয় নেতা নিয়ে বাজে মন্তব্য আসলে অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। আবেগ থেকে কেউ একজন রাস্তাঘাটে কী বলে ফেলবে না ফেলবে, সেই কথা চিন্তা করে ওনাকে সতর্ক করেছি মাত্র।
‘আর দল নিয়ে, নেতাদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করলে এ রকম প্রতিবাদ আমরা সামনেও করব’- বলেন ছাত্রদলের সহসভাপতি।
সমালোচনা করেই যাব: জাফরুল্লাহ
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, তিনি আগেও সমালোচনা করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।
বিএনপি ও ছাত্রদলকে ইঙ্গিত করে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তারা তো আর মাঠে গিয়ে আন্দোলন করতে পারছে না। খালেদা জিয়াকেও মুক্ত করতে পারছে না। তাই ঘরে বসে দুটো কথা বলে কাজ দেখাইল আর কি। আমি আগেও সমালোচনা করেছি, সামনেও করে যাব। সত্য বলতে দোষের কী?’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানিয়েছেন, তিনি সমালোচনা করা ছাড়বেন নাসেদিনের ঘটনা নিয়ে মনে কোনো ক্ষোভ আছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ঠিক ক্ষুব্ধ না, তবে হাসির মেটার এটা। দুইটা ছেলে সেদিন আগায় আসল। একজন এসে বলল আমাকে, তাদের নেতাকে নিয়ে কিছু না বলতে। আওয়ামী লীগ এক লোকের বন্দনা করে, বিএনপি আরেক লোকের বন্দনা করে। তারই ফলাফল এটা।’
প্রেস ক্লাবে সেদিন যা ঘটেছিল
শনিবার ওই সেমিনারের আয়োজক ছিল এডুকেশন রিফর্ম ইনিশিয়েটিভ (ইআরআই) নামে বিএনপি সমর্থক একটি সংগঠন। বিষয় ছিল ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: শিক্ষায় প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এবং করোনাকালীন শিক্ষা বাজেট: ২০২১-২০২২’।
আলোচনার একপর্যায়ে বিএনপি, তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন জাফরুল্লাহ। মন্তব্য করেন, ‘বিএনপি চলে লন্ডন থেকে আসা ওহি দিয়ে।’
তারেক রহমানকে দুই বছর চুপচাপ বসে লন্ডনে পড়ালেখার পরামর্শও দেন জাফরুল্লাহ।
এ সময় শ্রোতাদের আসনে থাকা ছাত্রদল নেতা কাউসার তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওস্তাদ স্লামাইকুম।’
মুহূর্তে সেমিনার কক্ষে উপস্থিত সবাই চমকে যান। সেই ব্যক্তি বলতে থাকেন, ‘আপনি বিএনপির কী? আপনি কে যে আপনার কথা শুনতে হবে? আপনি আমাদের নিয়া উল্টাপাল্টা কথা বলেন?’
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আপনি আগে কথা তো শোনেন।’
তখন ছাত্রদল নেতার সঙ্গে থাকা একজন বলেন, ‘আপনি জয়রে (প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়) নিয়া বলেন।’
জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আপনাদের ভালোর জন্য বলি। আপনারা আপনাদের ভালো বোঝেন না।’
ছাত্রদল নেতা কাউসার বলেন, ‘না না, আমরা অবশ্যই বুঝি, আমরা আমাদেরটা বুঝি, আপনি আপনারটা বোঝেন। আপনি আমাদের নেতাকে নিয়ে কখনও এভাবে কথা বলবেন না। আপনি আপনাকে নিয়ে কথা বলেন, যদি বলেন, পরবর্তী সময়ে কিছু হলে কিন্তু আমরা জানি না।’
জাফরুল্লাহ বলেন, ‘কোনো কিছু হবে না, আপনারা দায়ী হবেন কেন?’
কাউসার বলেন, ‘ধন্যবাদ।’
এই কথোপকথনের পর কাউসার তার সঙ্গীদের নিয়ে সেমিনার কক্ষ ত্যাগ করেন।