জাতীয় পার্টিতে এখন প্রার্থী সংকট। দলের দুজন প্রার্থী উপনির্বাচনের ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোয় দলে চলছে তোলপাড়। প্রার্থীরা ‘সমঝোতা’ করেছেন নাকি কোনো চাপের কারণে সরে দাঁড়িয়েছেন – এ নিয়ে দলে চলছে আলোচনা।
দলীয় প্রার্থী ও দল একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। ওই দুই প্রার্থী ‘সমঝোতা’ করে থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গত ২৪ জুন ঢাকা-১৪ আসনের উপনির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নেয়া মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক ভোট থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর তাকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়। মোস্তাক দলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
এর আগে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার পর ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোয় কুমিল্লা-৫ আসনে দলীয় প্রার্থী জসিম উদ্দিনকেও দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়ে এখন দলকেই এ জন্য দায়ী করছেন এ প্রার্থী।
ওই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আবুল হাশিম খাঁন।
ঢাকা-১৪ আসনে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন চার জন। তারা হলেন: আওয়ামী লীগের আগা খান মিন্টু, জাপার মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, জাসদের আবু হানিফ ও বিএনএফের কেওয়াইএম কামরুল ইসলাম। মোস্তাক, হানিফ ও কামরুল ভোট থেকে সরে যান। ফলে আওয়ামী লীগের আগা খান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মৃত্যুতে ঢাকা-১৪ ও আবদুল মতিন খসরুর মৃত্যুতে কুমিল্লা-৫ আসন শূন্য ঘোষণা হওয়ার পর সেখানে উপনির্বাচনের তারিখ দেয়া হয়েছিল। নির্বাচনে কারচুপি হয় এমন অভিযোগ এনে বিএনপি আগেই জানিয়েছে, তারা ভোটে আসবে না। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আওয়ামী লীগের।
বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে: মোস্তাক
ঢাকা-১৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হওয়া মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। কারণ পার্টি কোনো সহযোগিতা করে নি, কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। একটি কাগজ দিয়ে মাঠে ছেড়ে দিছে।’
তার বিরুদ্ধে সমঝোতা করার অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কারও সমঝোতা হয় নি। আমার সঙ্গে কারও দেখা হয় নি। সমঝোতার কোনো প্রশ্নই আসে না। আগা খান মিন্টুর সঙ্গে আমার তো দেখাই হয় নি।’
প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য কে দায়ী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই দল। কারণ প্রার্থী হওয়ার পর ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগে আমি দলীয় চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। দল যদি আশ্বাস দিত, বলত নির্বাচন করো, যত ধরনের সমস্যা আছে আমরা ফেস করবো, কেউ যদি নির্বাচন বহির্ভূত কাজ করে প্রয়োজনে আমরা সাংবাদিক সম্মেলন করব - তাহলে আমি নির্বাচন করতাম।’
দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি নিজে কেন সংবাদ সম্মেলন করলেন না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি নিজে করা কিংবা দলের চেয়ারম্যান করা এক নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান স্যারকে বললাম, আপনারা যদি কোনোভাবে কোনো ইনিশিয়েটিভ না নিয়ে মাঠে ছেড়ে দেন, তাহলে আমরা কী করে নির্বাচন করব। গত বারের মতো আমার ঝামেলা হবে। সে ক্ষেত্রে আপনারা যদি কোনো পদক্ষেপ না নিতে পারেন, কোনো সংবাদ সম্মেলন না করতে পারেন, তাহলে আমরা কী করে নির্বাচন করব? দলের মহাসচিবের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে।’
মোস্তাক বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনেও আমি প্রার্থী ছিলাম। সেবার আমার ছেলে-পেলেদের হুমকি-ধামকি দেওয়া হয়েছিল। আমি চেয়ারম্যানকে বলার পরও কোনো অ্যাকশন হয় নি।’
তাহলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর কেন তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হলেন, জানতে চাইলে মোস্তাক বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান তার ক্ষমতাবলে আমাকে বহিষ্কার করেছেন। দলীয় গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকেই এটা করেছেন। তবে অনেকেই দলের চেয়ারম্যানকে অনেক কিছু ভুল বোঝায়।’
মোস্তাকুর রহমান মোস্তাককে বহিষ্কার করার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির দপ্তর সম্পাদক রাজ্জাক খান বলেন, ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় মোস্তাকুর রহমান মোস্তাককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
কুমিল্লায় জেলা কমিটিই বাতিল
কুমিল্লা-৫ আসন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন জসিম উদ্দিন। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।
তবে এ প্রত্যাহারের কারণে ২১ জুন কুমিল্লা জাতীয় পার্টির কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন দলটির জেলা কমিটির সভাপতি (বর্তমানে সাবেক) ইয়ার আহমেদ সেলিম। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে জানিয়ে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলুও।
বাবলু বলেন, ‘কুমিল্লা জেলার কমিটি বাতিল করা হয়েছে। কারণ ওরাই তো সুপারিশ করেছিল প্রার্থীর (কুমিল্লা-৫) ব্যাপারে। সে বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দেবে।’
জাতীয় পার্টির নেতা ইয়ার আহমেদ সেলিম নিউজবাংলাকে বলেন,‘উনি (জসিম উদ্দিন) জুলাই মাসের ১৭ তারিখের পর থেকে আর যোগাযোগ করেন নি। তিনি মোবাইল বন্ধ করে রাখছেন। তিনি আমাকে ১৬ তারিখে বললেন, প্রতিপক্ষ আমাকে হুমকি দেয়। আমি বললাম, এগুলোর জন্য ভয় পেয়ে লাভ নাই। রাজনীতি করলে এগুলো আসবেই। জেলা পর্যায়ে যদি কোনো সাহায্য সহযোগিতা লাগে, আমরা করব। হুকমি দিলে আমরা প্রশাসনকেও বলব। এর পরে তিনি আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন নি।’
তিনি বলেন, ‘উনি (জসিম উদ্দিন) আমাদের না জানিয়েই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। এটা নিয়ে দল তদন্ত করছে।’
কোনো চাপে উনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন কি না, জানতে চাইলে ইয়ার আহমেদ সেলিম বলেন, ‘আমরা এটা বুঝতে পারছি না। তবে আমি চাপ দেখি নি। যদিও তিনি বলেছেন, চাপ আসছে।’
তিনি সমঝোতা করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো এখন বলতে পারছি না। যেহেতু চার দিন আগেই তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন, এটা তিনিই জানেন। এটা আমাদের তিনি বলেন নি। তবে তার আশেপাশের সহকর্মীরা বললেন, ওইখানকার লোকজন ও পারিবারিক চাপেই তিনি এটা প্রত্যাহার করেছেন।’
জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দল থেকে সহযোগিতা করা হয় না এ বিষয়টি কিছুটা হলেও সত্য। লক্ষ্মীপুরে উপনির্বাচনে এ বিষয়টি আমরা লক্ষ্য করেছি। এ ছাড়া ঢাকা-৫ আসনেও দল থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হয় নি। তবে তারা কী কারণে সরে দাঁড়ালেন, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
সমঝোতা কিনা জানারও দরকার নেই
প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর দায় দলের ওপর বর্তায় কিনা জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এর প্রশ্নেই উঠে না। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা যদি নির্বাচন করতে পারেন, তাহলে করেন। মাঝপথে সরে গেলে ব্যবস্থা নেব। এই মুচলেকা দিয়েই তারা প্রার্থী হয়েছিলেন।’
প্রার্থীরা সম্ভাব্য সমঝোতার ব্যাপারে তদন্ত করার দরকার মনে করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন দরকার নাই। তারা সমঝোতা করেছে কি না আমাদের জানারও দরকার নাই। কারণ আমরা তাদের বলেছি, তোমরা নির্বাচন করলে শেষ পর্যন্ত থাকবা। প্রত্যাহার করলে দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
বাকি দুই উপনির্বাচন
চারটি আসনে উপনির্বাচনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর-২-এ জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ পর্যন্ত থাকলেও সেখানে তিনি সুবিধা করতে পারেননি। সেখানে আওয়ামী লীগের নৌকায় সাড়ে ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকের প্রার্থী নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। উপনির্বাচনে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জাপার ‘লাঙ্গল’ প্রতীকের শেখ মোহাম্মদ ফায়িজ উল্যাহ পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৮৬৮ ভোট।
এর বাইরে সিলেট-৩ আসনেও ভোট হচ্ছে। সেখানে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়া আতিউর রহমান আতিক এখন পর্যন্ত ভোট নিয়ে আগ্রহী। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া হাবিবুর রহমানের প্রার্থিতা ঠেকাতে তিনি চেষ্টাও করেছেন।
পৌর নির্বাচনেও প্রার্থী সংকট
এর আগে পৌর নির্বাচনেও প্রার্থী সংকটে ছিল জাতীয় পার্টি।
গত ২৮ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম ধাপে জাতীয় পার্টির দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুরের বদরগঞ্জেও প্রার্থী ছিল না জাতীয় পার্টির। জাতীয় পার্টির আরেক দুর্গ কুড়িগ্রামেও প্রার্থী পায়নি দলটি।
পৌরসভা নির্বাচনে প্রথম তিন ধাপে জাতীয় পার্টি ৩২ জন মেয়র প্রার্থী দিয়েছিল। এদের মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে ২৪ পৌরসভায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল মাত্র চারটিতে। দ্বিতীয় ধাপে ৬১ পৌরসভায় হওয়া ভোটে ১৪টিতে লড়াই করে দল। ৩০ জানুয়ারি তৃতীয় ধাপে ৬৪ পৌরসভার মধ্যে দলটি প্রার্থী দিয়েছিল ১২টিতে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বৃহত্তর রংপুরের ২৪টি আসনের মধ্যে নীলফামারী জেলা ছাড়া সব আসন ধরে রাখে জাতীয় পার্টি। তবে ১৯৯৬ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ আসনগুলো দখলে নিতে শুরু করে। মাঝে জামায়াতে ইসলামীও নীলফামারীর একটি আসনে দুবার জিতেছে। তবে গত দুটি সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ছাড়ে এই জেলার দুটি আসন জিতেছে জাতীয় পার্টি।