বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আওয়ামী লীগ কি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারাচ্ছে?

  •    
  • ২৩ জুন, ২০২১ ১৯:৫৬

২০০৬ সালে খেলাফত মজলিসের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে হেফাজতের ব্যাপারে নমনীয় আচরণ –গত দেড় দশক ধরে প্রশ্ন উঠছে, ধর্মনিরেপক্ষ অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ সরে গেছে কিনা বা গেলে কতটুকু সরেছে। দলের নেতারা বলছেন, দল অটুট আছে। অনেকে বলছেন, ভোটের রাজনীতি প্রভাব ফেলছে। 

রাজনৈতিক দল হিসেবে বরাবরই ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে এসেছে আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক সময়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা কৌশলগত যোগাযোগ ও সবশেষ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার জানাজায় গার্ড অব অনার দেয়া থেকে নারী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিরত রাখার প্রস্তাব সংক্রান্ত ইস্যুতে নতুন করে সমালোচনায় পড়েছে দলটি।

আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে যাচ্ছে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ ও সমালোচনা দেখা দিচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যদিও এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, আওয়ামী লীগ কখনই তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে যায়নি।

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেওয়ায় নারী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) বিকল্প চেয়ে সম্প্রতি সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ কমিটির প্রধান আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ এবং সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। বাকি সদস্যরাও অধিকাংশই আওয়ামী লীগের।

সংসদীয় কমিটি কী করে নারী-পুরুষ বৈষম্যমূলক ও জেন্ডার স্পর্শকাতর একটি সুপারিশ করল, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। পরদিনই জাসদ নেতারা এটির তীব্র সমালোচনা করে সংসদে বক্তব্য রাখেন। তবে শেষ পর্যন্ত সরকার এই পরামর্শ আমলে নেয়নি।

এর আগেও, ইসলামপন্থি উগ্র সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারের পরও নমনীয় আচরণ করায় সমালোচনা পড়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অবশ্য হেফাজত, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করলে তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় মুখ খোলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে শেষ পর্যন্ত যাত্রাবাড়ীর ওই সড়কদ্বীপে ভাস্কর্য স্থাপন থেকে সরকার সরে এসেছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।

এর আগে ২০১৭ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থিদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে নমনীয় অবস্থান নিতে দেখা যায় সরকারকে।

গত কয়েক বছরে দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়ার বিষয়টি স্পষ্ট। আর সরকারও তাদের নানা দাবিতে নানা সময় নমনীয়তা দেখিয়েছে

ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনার উপলক্ষ তৈরি হয় ২০০৬ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থি দল খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করে। তবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সে চুক্তি থেকে দলটি সরে আসে। তখন থেকেই ভোটের রাজনীতিতে এটি স্পষ্ট হয় যে, দেশে ইসলামপন্থি দলগুলোর যে ভোট ব্যাংক রয়েছে, সেটির একটি অংশ পেতে আওয়ামী লীগ আগ্রহী।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে শরিক হিসেবে একটি ইসলামি দল রয়েছে, যেটির নাম বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন (নজিবুল বশর)। এছাড়া মহাজোটে আছে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ)।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে ইসলামী ঐক্যজোট (নেজামী), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) ও জাকের পার্টির (মোস্তফা আমীর) সঙ্গে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সমঝোতা হয়।

এইসব প্রবণতার কারণে মনে করা হয়, ভোটের রাজনীতির সমীকরণের কথা মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপক্ষতার নীতিতে কিছু পরিমাণে হলেও আপস করছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় গঠনতন্ত্রে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও মূলনীতি অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি (পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত) বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র, সকল ধর্ম, বর্ণ ও নৃ-গোষ্ঠীর সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভীষ্ট লক্ষ্য।’

তবে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণও ঐতিহাসিকভাবে একটি ভোটের রাজনীতির সমীকরণ ছিল বলে মনে করেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ হিসেবে এ দলের জন্ম হয়, তখন শুধু মুসলমানরাই এর সদস্য হতে পারতেন। ১৯৫৪ সালে যখন যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হয়, তখন সেটা ছিল পৃথক নির্বাচন।

তিনি বলেন, ‘এর মানে হলো মুসলমানরা মুসলমানদের ভোট দেবে আর অমুসলমানদের আলাদা প্রার্থী থাকবে। আওয়ামী লীগ একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করবে এবং সব ধর্মের দল নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করবে। এটা যুক্তফ্রন্টের ম্যানিফেস্টোতে ছিল।

‘এ কারণে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বড় সমর্থন আওয়ামী লীগ ৯৫৪ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল। এর ফলাফল হচ্ছে ১৯৫৫ সালে যে কাউন্সিল হয়, সেখানে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম আওয়ামী লীগ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ম্যানিফেস্টো এবং তখন সব দলের সভাপতিরা রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের যে ভাষণ, দুই জায়গাতেই বলা আছে, কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন আওয়ামী লীগ করবে না। এটা একটা প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতিটা আওয়ামী লীগ এই ২০২১ সাল পর্যন্ত ধরে রেখেছে।

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি সমালোচনা ছিল, এরা বোধ হয় ইসলামবিরোধী। সুতরাং এই সমালোচনা কাটাতে শেখ মুজিব এই ঘোষণা দিয়েছিলেন।’

ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখে সরকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণও ঝুলিয়ে রেখেছে

অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দলটি বরাবর অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কখনোই তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে আসেনি। দল সব সময় বিশ্বাস করে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। প্রত্যেকের ধর্মের প্রতি রাজনৈতিক দল হিসেবে শ্রদ্ধা করি। কোনো ধর্মের কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা এটা আমাদের দলের নীতি বিরুদ্ধ।’

তিনি বলেন, ‘ধর্ম দিয়ে কখনও রাষ্ট্র পরিচালিত হয় না। কোনো ধর্মের উপর অন্য কোনো মতাদর্শও চাপিয়ে দেয়া যায় না। এ নীতি থেকে আওয়ামী লীগ কখনোই বিচ্যুত হয়নি।’

তবে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি থেকে আওয়ামী লীগ সরে এসেছে বলে মনে করেন

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে গঠনতন্ত্রে আছে। কিন্তু বিভিন্ন উগ্রবাদী দলগুলো অথবা সাম্প্রদায়িক দলগুলোর সাথে বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যে মেলবন্ধন আমরা লক্ষ্য করি, তা এই গঠনতন্ত্রের পরিপন্থি। একই সাথে মনে হয়, যে আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়েছিল, সেই আদর্শকে ধারণ করতে যে কোনো কারণেই হোক তারা তা পারছে না।

‘এটার কারণে আমি মনে করি, তাদের কাছে এখন আদর্শের রাজনীতির চেয়ে ভোটের রাজনীতি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই ভোটের রাজনীতি সত্তরেও ছিল, বঙ্গবন্ধুর সময়, কিন্তু সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক বা ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের কাছে আপোস করেননি, আত্মসমর্পণও করেননি। এখানেই সত্তরের আওয়ামী লীগ ও এখনকার আওয়ামী লীগের মধ্যে ব্যতিক্রম।’

অবশ্য আওয়ামী লীগ ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নমনীয় এ কথার সাথে দ্বিমত রয়েছে ধর্মভিত্তিক দল ও আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোটসঙ্গী তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি আদর্শিক দল। স্বাধীনতা এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।

‘আমার যেটা মনে হয়, বিভিন্ন ইসলামী দল বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী দল, জঙ্গিবাদের বিষয়ে যাদের অবস্থান আছে, অনেকে যারা জাতীয় পতাকাও তোলে না বা জাতীয় সংগীতকে অস্বীকার করে – এ ধরনের দলগুলো যেন দেশবিরোধী অবস্থানে বা জঙ্গিবাদের দিকে চলে না যায় এ জন্য আওয়ামী লীগ বলবে না সরকার তাদের সুযোগ দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ভোটের জন্য ইসলামপন্থি উগ্রবাদী দলগুলোর প্রতি নমনীয় এটা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রেখে যারা (ইসলামী দল) আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে, আর স্বাধীনতার স্বপক্ষের যারা এখনও নেই তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো রাজনৈতিক দলেরই নিবন্ধন থাকা উচিত না।’

এ বিভাগের আরো খবর