দেশের পুরনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ৭২ বছর পূর্ণ করেও এখনও দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে যাচ্ছে।
দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে দলটির ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবার করোনাকালে পালিত হবে সীমিত পরিসরে।
পাকিস্তান আমলে স্বাধীকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়া দলটি আজকের এই অবস্থানে আসা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দাঁড় করান রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার ও পর্যবেক্ষকরা।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন ভবনে জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের। পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দলের রাখা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
সে সময় প্রতাপশালী মুসলিম লীগের সঙ্গে লড়াই করে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের পর জাসদ, এরপর জিয়াউর রহমানের সেনাশাসন, পরে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সেনাশাসন এরপর বিএনপির সঙ্গে লড়াই, প্রতিযোগিতা করে আজকের অবস্থানে এসেছে দলটি।
এক কালের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা আজ নিভু নিভু, ৯০ দশকের পর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও অনেকটাই নিষ্প্রভ। এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আপাতদৃষ্টিতে অপরাজেয় বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে অগণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের অভিযোগও আনা হচ্ছে, যদিও তা উড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল।
আন্দোলনের ‘সেরা’
বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এখন পর্যন্ত যত বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোর নেতৃত্বই এসেছে আওয়ামী লীগ থেকে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলটিও আওয়ামী লীগ।
স্বাধীন বাংলাদেশে সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো, ৯০ দশকে বিএনপি সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা, ২০০৭ সালে একদলীয় নির্বাচন ঠেকিয়ে দেয়ার সাফল্য আছে দলটির।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পাঁচ বছর টিকে থাকা, পর পর তিন বার ক্ষমতায় আসা, টানা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার রেকর্ডও আওয়ামী লীগের।
পথসভায় বক্তৃতা রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ছবি: আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট
২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু করে। এরই মধ্যে শীর্ষ অপরাধীদের সাজা কার্যকরও করা হয়েছে। বাকিদের বিচার চলমান।
তবে আজকের এ পর্যায়ে আসতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরোতে হয়েছে দলটিকে। বহুবার ভাঙনের মুখেও পড়েছে দলটি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তৎকালীন সামরিক শাসক নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগকে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরে আসে দলটি।
কী বলছেন নেতারা
দলের ইতিহাস বলতে গিয়ে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অপর নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে যে নির্বাচন, সেখানে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগ জয়লাভ করে এবং মুসলিম লীগের তৎকালীন সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকার গঠন করেন।
‘কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বক্ষণে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে দেয়া হয় এবং তার স্থলে খাজা নাজিমুদ্দিনকে অভিষিক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, মুসলিম লীগের কমিটি না ভেঙে হঠাৎ করে স্বঘোষিত সভাপতি হয়ে গেলেন মাওলানা আকরম খাঁ। তার কাছে যখন সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তানের তরুণ কর্মীরা সদস্য সংগ্রহের বই আনতে গেলেন, তখন তিনি তা দিতে অস্বীকার করলেন সোহরাওয়ার্দী ভীতির কারণ। তখন থেকেই গোলমালের সূত্রপাত।’
তিনি বলেন, ‘এই সময়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় আসেন। তখন তিনি পরামর্শ দিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার জন্য বিরোধী দল প্রয়োজন। তোমরা দল গঠন করো। আমিও পশ্চিম পাকিস্তানে সেইভাবে কাজ শুরু করেছি। নামেরও সাজেসন দিলেন।
‘তখন ঢাকায় ১৫৫ মোগলটুলি ছিল মুসলিম লীগের একটি শাখা অফিস। তখন সেই অফিসকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহীরা কাজ পরিচালনা করতেন। এখান থেকেই ভাষা আন্দোলন থেকে অন্যান্য আন্দোলনের তারা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
‘পরে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৪৯ এর ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে কর্মিসম্মেলন ডাকা হয় এবং সেখান থেকেই মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হক সাহেবকে সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধুকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই থেকেই যাত্রা শুরু। পরে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন, যার মূল নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ।’
আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া ছবি
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের মতে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই আওয়ামী লীগের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে সে লক্ষ্য পুরণ হয়েছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। আজকে ভাবতে ভালো লাগে বঙ্গবন্ধু সেই লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার লক্ষ্যই ছিল স্বাধীনতা।
‘বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা, যিনি বলেছিলেন পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরকেই হতে হবে। এ লক্ষ্য সামনে নিয়েই তিনি সংগ্রাম করেছেন। তিনি প্রথমে নিজেকে, তারপর দেশকে, তারপরে তার যে নীতি ও আদর্শ সেটাকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি অনেকবার, ১৩ বছর কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন, কিন্তু কোনদিন মাথা নত করেননি। তিনি যে লক্ষ্য নিয়ে আরম্ভ করেছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড, সে লক্ষ্য তিনি পূরণ করেছেন।’
ছয় দফা আন্দোলনের সাফল্য ভিত
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে শুরুতে আওয়ামী লীগ তার পূর্ববর্তী সংগঠন মুসলিম লীগের আদর্শেই পরিচালিত হয়েছে। পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিষয়গুলো সামনে এলে গণমুখী আদর্শ ধারণ করে আওয়ামী লীগ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে সময় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার দুই বছর আগে পাকিস্তান হলো। যারা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করলেন, তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সামনের সারির নেতা ছিলেন। এরপর মুসলিম লীগের ভেতরে গণতন্ত্রায়নের দাবিতে তারা ক্ষুব্ধ ছিলেন।
‘তখন মুসলিম লীগ ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ করা হতো নবাববাড়ি থেকে। তারা এর বিরুদ্ধে জনগণের মুসলিম লীগ বানাতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ বানালেন। এটা মূলত মওলানা ভাসানীর উদ্যোগ, তার সাথে এখানকার তরুণ নেতারাও ছিলেন। করাচিতে সোহরাওয়ার্দী বানালেন জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। তারা পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের রাজনীতিরই লিগেসিটা বহন করছিলেন।’
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘পরে ধীরে ধীরে তাদের একটা রিয়েলাইজেশন হয়, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের, যে পূর্ব বাংলা বঞ্চিত হচ্ছে। তারপর আওয়ামী লীগের মধ্যেও পরিবর্তন হয়, তারা সেই পাকিস্তানবাদ ছেড়ে গণমুখী হয় এবং পরে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে যোগ দেয়। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছয় দফার মাধ্যমে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন দানা বাঁধে।
আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেইজ থেকে নেয়া ছবি
এই গবেষকের মতে, ছয় দফার সাফল্যই আওয়ামী লীগকে সাহসী করে তোলে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ছয় দফা নিয়ে এগুতে থাকে এবং জনগণের ম্যান্ডেট তাদের অনেক বেশি আস্থাশীল করে তোলে।
‘পুরো পর্বটি জুড়েই আমরা বলতে পারি, পূর্ব বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল এবং ৭০ সালের পর আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠলেন পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র নেতা। তাকে মানুষ ভালোবেসে নাম দিলো বঙ্গবন্ধু।’